চোখ তুলে চাঁদের পানে চেয়েছিল ফোদারিনগে।
উত্তাল উচ্ছ্বাসে ক্ষণিক বিরতি দিয়ে বলেছিল শেষকালে, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
বাড়াবাড়ি আবার কীসের? তেড়ে উঠেছিলেন মি. মেডিগ। চাঁদ থামে না ঠিকই। আপনি থামিয়ে দিন পৃথিবীর বনবন করে লাটুর মতো পাক খাওয়াটা। তাহলে দাঁড়িয়ে যাবে সময়। ক্ষতি তো কারও করছি না।
তা মন্দ বলেননি! গোঁফে তা দিতে দিতে বলেছিল ফোদারিনগে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। বেশ, তাহলে চেষ্টা করেই দেখা যাক।
বলা বাহুল্য, হুকুমটা মামুলি হুকুম নয়। এত বড় হুকুম দিতে গেলে নিজেকে আগে তৈরি করা দরকার। এই মুহূর্তে ফোদারিনগের ইচ্ছাশক্তি অবশ্য ফ্যালনা নয়, তাহলেও পৃথিবীর আবর্তন স্তব্ধ করতে হলে পুরো ইচ্ছাশক্তিটাকে কথার হুকুমের মধ্যে জড়ো করা দরকার। তাই আটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছিল ফোদারিনগে। কোটের বোতাম এঁটে নিয়ে ধরিত্রীকে উদ্দেশ্য করে সাধ্যমতো আত্মবিশ্বাস কণ্ঠস্বরে ঢেলে দিয়ে বলেছিল, ওহে পৃথিবী, বন্ধ কর আবর্তন।
পরক্ষণেই, ধাঁ করে শুন্যপথে ডিগবাজি খেতে খেতে ছিটকে গিয়েছিল মিনিটে ডজন। ডজন মাইল গতিবেগে। সেকেন্ডে অগণিত চক্রবর্ত রচনা করা সত্ত্বেও চিন্তা করার মতো ক্ষমতাটা লোপ পায়নি ফোদারিনগের। চিন্তার মতো জিনিস আর আছে? কখনও তরল পিচের মতো ঘোলাটে থকথকে, আবার কখনও আলোর মতো ঝকঝকে চকিত। তাই একটা সেকেন্ডের মধ্যেই চিন্তাকার্য সমাপন করে নিয়ে ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছিল ফোদারিনগে এইভাবে–সব কটা হাড় আস্ত অবস্থায় যেন নিরাপদে নামতে পারি। যা-ই। ঘটুক-না কেন, আস্ত শরীরখানাকে দেখে-শুনে ভালো জায়গায় নামিয়ে দাও।
মোক্ষম সময়েই ইচ্ছাশক্তি জাহির করেছিল ফোদারিনগে, আর এক পলক দেরি হলেই জ্বলে যেত নিজেই। বাতাসের মধ্যে দিয়ে অত জোরে ধেয়ে গেলে জামাকাপড় ঝলসে তো যাবেই। মুখ থেকে হুকুমটা খসতে-না-খসতেই হুড়ম করে নেমে এসেছিল মোটামুটি ভদ্রস্থভাবেই টিপির আকারে রাখা সদ্য-খোঁড়া নরম মাটির ওপর। দমাস করে নামলেও চোট লাগেনি মোটেই, হুকুমই যে ছিল তা-ই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক পাশেই প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়েছিল একতাল ধাতু-ইট-কাঠ-পাথর, বস্তুপিণ্ডটার সঙ্গে অসাধারণ সাদৃশ্য রয়েছে বাজার চত্বরের ঘড়ি-মিনারের। মাটিতে পড়েই ঠিকরে গিয়েছিল ফোদারিনগের মাথার ওপর দিয়ে এবং বোমার মতো ফেটে গিয়ে ইট-কাঠ-পাথর হয়ে ছিটকে গিয়েছিল। দিকে দিকে। মস্ত একটা পাথরের চাঁইয়ের ওপর কোত্থেকে দড়াম করে এসে পড়ল একটা উড়ন্ত গোরু এবং নিমেষমধ্যে পিণ্ডি পাকিয়ে গেল ডিমের মতোই। দুমদাম ধড়াম-ধাম, আওয়াজের পর আওয়াজে ফোদারিনগের মাথা তখন বনবন করে ঘুরছে। জীবনে এমন প্রচণ্ড আছড়ে পড়ার শব্দপরম্পরা সে শোনেনি, একটা শব্দ কানের পরদা ফাটানোর উপক্রম করতে-না-করতেই আবার কান-ফাটানো শব্দ খাবলা মেরে নিচ্ছে যেন মগজখানাকেই। ভয়ংকর আওয়াজগুলোর ঢেউ চলে যাওয়ার পরেই এল ছোটখাটো ভাঙাচোরা আছড়ে পড়ার ক্রমশ ম্রিয়মাণ শব্দলহরি। আগাগোড়া অব্যাহত রইল কিন্তু প্রলয়ংকর ঝোড়ো হাওয়া, স্বর্গ-মর্ত জুড়ে তাণ্ডবনাচ নেচে বেড়াচ্ছে সেই মত্ত প্রভঞ্জন, ঝড় যে এত জোরালো হয়, ফোদারিনগে তা জানল সেই প্রথম। সে কী তেজ হাওয়ার। মাথা তুলে চারপাশে চোখ বোলাতেও পারছে না, মুভুখানা ছিঁড়ে উড়িয়ে নিয়ে না যায়। বেশ কিছুক্ষণ এমনই ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় ছিল বেচারি, যে ভালো করে নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারেনি। কোথায় আছে এবং কী ঘটছে, তা চোখ মেলে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। সংবিৎ ফেরার পর প্রথমেই খুলিতে হাত বুলিয়ে দেখে নিয়েছিল, ধড়ে মুন্ডুটা এখনও আছে কি না। ফরফর করে চুল উড়ছে টের পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল অবশেষে, যাক, মাথাটা এখনও বেহাত হয়নি।
লর্ড! খাবি খেতে খেতে ইষ্টনাম জপ করা ছাড়া ঝড়ের মধ্যে আর কোনও কথা ফোটেনি মুখে। তারপর অবশ্য আঁকুপাঁকু করতে করতে পাগলের মতো বকে গিয়েছিল নিজের মনে, ব্যাপারটা কী? ঝড় আর বাজ পড়ার আওয়াজে কান যে চৌচির হয়ে গেল! অথচ এক মিনিট আগেও কী মিষ্টিই না ছিল রাতটা, ফুটফুটে চাঁদের আলো! মেডিগের কথায় কান দিয়েই তো বাধিয়ে বসলাম ফ্যাসাদটা! উফ! হাওয়ার কী জোর রে বাবা! এ কী করে বসলাম নিরেট গাধার মতো! এখুনি যে পটোল তুলতে হবে সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্টে!…
মেডিগটা গেল কোথায়?
তুলকালাম কাণ্ডটাই বা ঘটল কেন?
ঝড়ে কোট উড়ছে পতপত করে চোখের সামনে। তারই ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, দেখে নিল ফোদারিনগে। সত্যিই চারপাশে অত্যন্ত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে চলেছে। দেখে-শুনে বিলকুল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফের নিজের মনেই বকর বকর করে চলে অঘটনবাজ ফোদারিনগে, আকাশটা তো দেখছি ঠিক জায়গাতেই আছে–এখনও খসে পড়েনি। কিন্তু বিকট-ভয়ানক এই ঝড় বেটাচ্ছেলে তেড়েফুঁড়ে আসছে কোন চুলা থেকে? ওই তো চাঁদ দেখা যাচ্ছে মাথার ওপর। আগে যেখানে ছিল–ঠিক সেইখানেই। দিনদুপুরের মতো আলোরও ঘাটতি নেই। ওইটুকুই কেবল আগের মতো–বাকি তো সবই ওলট-পালট–গাঁ টা গেল কোন চুলোয়? কিছুই তো চোখে পড়ছে না–বিটকেল এই ঝড়খানাই বা এল কোন নরক থেকে? ঝড় ওঠার হুকুম তো আমি দিইনি।