রাত তখন এগারোটা। অলৌকিক কাণ্ডকারখানার ঠেলায় খাবার কথা একদম খেয়াল নেই। খেয়াল হল পেট চুঁইছুঁই করতেই। অথচ খাবার যার আনার কথা, সেই মহিলাটির টিকি দেখা যাচ্ছে না। দায়িত্বজ্ঞানহীনা, কাণ্ডজ্ঞানহীনা এই মহিলার ওপর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মি. মেডিগ। বরাবরই কাজে ফাঁকি দিয়ে অভ্যস্ত। কিছুতেই বাগে আনতে পারেননি তিনি। খিদে মিটিয়ে দিয়েছিল ফোদারিনগে অতি সহজেই। অলৌকিক ক্ষমতার ব্যাপকতর প্রয়োগের সম্ভাবনাটা মাথায় এসে গিয়েছিল পেট চনমন করতেই। অর্ডার দিতেই শূন্য থেকে রাজসিক খানার পর খানা এসে গিয়েছিল টেবিলে। যার যেটা খেতে এবং পান করতে ভালো লাগে–ঠিক সেই সেই খাদ্য এবং পানীয় হাজির হতেই দুজনেই। বীরবিক্রমে সেসব আক্রমণ করেছিল সবার আগে। তারিয়ে তারিয়ে রসাস্বাদন করার পর আবার মগজ খুলে গিয়েছিল ফোদারিনগের। আরও ভালোভাবে অলৌকিক ক্ষমতাটাকে কাজে লাগানোর উৎকৃষ্ট একটা মতলব এসে ছিল মাথায়। প্রস্তাবটা শুনে তো প্রথমে হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন মি. মেডিগের মতো পরমোৎসাহী পুরুষও। এ কাণ্ড যদি সম্ভব হয়। তাহলে সমাজ-সংসারের ভোল ফিরিয়ে দেওয়া যাবে যে!–না হওয়ার কী আছে? জিদ ধরেছিল ফোদারিনগে, হুকুম দিয়েছিল নিজের ইচ্ছানুযায়ী।
বিচিত্র হুকুম নিঃসন্দেহে। হাউসকিপারের মতিগতি যাতে এখন থেকে পালটে যায়, ঘরকন্নায় নজর দেয়, কাণ্ডজ্ঞান যেন ফিরে আসে… ইত্যাদি… ইত্যাদি। হুকুমের ফোয়ারা ফুরানোর আগেই অদ্ভুত আওয়াজের পর আওয়াজ শোনা গিয়েছিল ওপরতলায়। ধড়মড়িয়ে। দৌড়েছিলেন মি. মেডিগ। ফিরে এসে চোখ বড় বড় করে বলেছিলেন, আজব কাণ্ড! নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল মেয়েটা। ঘুমের মধ্যেই ইচ্ছাশক্তি কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে! তোবা! তোবা!
না করার কী আছে? প্রতিবাদের সুরে বলেছিল ফোদারিনগে–জাগরণে-স্বপনে সবসময় কার্যকর হবেই আমার ইচ্ছাশক্তি।
ব্র্যান্ডি খেয়ে ঘুমাচ্ছিল মশায় নাক ডাকিয়ে। সুবুদ্ধি ফিরে এসেছে ঘুমন্ত অবস্থাতেই। ঘুম থেকে উঠেই লুকানো এক বোতল ব্র্যান্ডি বার করে আছড়ে ভেঙেছে… এখন জ্বলছে। অনুতাপে। তোবা! তোবা! তোবা!
এবার তাহলে উইঞ্চের ব্যাপারটা
রাখুন আপনার উইঞ্চের ব্যাপার! আশ্চর্য! আশ্চর্য! আশ্চর্য! এ কী আশ্চর্য ক্ষমতা পেয়েছেন আপনি! সীমাহীন সম্ভাবনা… যতই দেখছি, ততই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি। শুনবেন, আরও কী কী করা যায় আপনাকে দিয়ে?
বলেই সম্ভবপর অলৌকিক ঘটনাবলির ফিরিস্তি শোনাতে শুরু করে দিয়েছিলেন মি. মেডিগ–উইঞ্চকে ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে আনার কথায় কানই দেননি। শুধু মুখে কথা নয়, হাতেনাতে কাজও আরম্ভ করে দিয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ–অবশ্যই ফোদারিনগে বেচারির সহযোগিতায়। শিকেয় তোলা রইল ফোদারিনগের আসল সমস্যা। দুই মূর্তিমান অত রাতে বেরিয়ে পড়েছিল শহরময় চরকিপাক দিয়ে শহরের ভোল ফেরানোর অসম্ভব দায়িত্ব নিয়ে। ঘটেছিল বিস্ময়কর পরিবর্তনের পর পরিবর্তন। কনকনে শীতের রাতে নিথর চাঁদের নিপলক চাহনির নিচে দেখা গিয়েছিল দুই অলৌকিক ঘটনাবাজকে। হাত-মুখ নেড়ে বিষম ফুর্তিতে আটখানা হয়ে পরিবর্তনের প্ল্যান ঝেড়ে যাচ্ছেন মি. মেডিগ–প্ল্যানমাফিক অদ্ভুত অদ্ভুত ফরমাশ দিয়ে যাচ্ছে ফোদারিনগে। প্রথম প্রথম হুকুম দেওয়ার সময়ে যেটুকু দ্বিধা বা লজ্জা ছিল–এখন তা তিরোহিত হয়েছে। এখন রোমাঞ্চ-উল্লাসে মাথার চুল খাড়া হয়ে রয়েছে বললেই চলে। একরাতেই পার্লামেন্টারি ডিভিশনের সব কটা মাতালের মদ্যাসক্তির নিবারণ ঘটিয়েছিল এই দুজনে এবং জলে রূপান্তরিত করেছিল সব কটা পানশালার বিয়ার আর অ্যালকোহল (এই বিষয়টিতে প্রবল আপত্তি করেছিল অবশ্য ফোদারিনগে কিন্তু তুড়ি মেরে সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়েছিলেন মি. মেডিগ)। রেলপথের বিস্তর উন্নতিও ঘটিয়েছিল দুই নিশাচর। ফ্লিনডারের জলাভূমি থেকে বার করে দিয়েছিল সমস্ত জল আর কাদা। ওয়ান ট্রি হিল-এর মাটির উৎকর্ষসাধনও করে ছিল দুজনে। সেই সঙ্গে অদৃশ্য করেছিল পল্লি-পুরুতের ছিনেজোঁক আঁচিল। সাউথ ব্রিজের জখম জেটি মেরামতের মতলব নিয়ে হনহন করে যেতে যেতে রুদ্ধশ্বাসে মি. মেডিগ যখন বলছেন, কাল থেকে এ জায়গা চেনা যাবে না–পিলে চমকাবে প্রত্যেকেরই কৃতজ্ঞতায় গদগদ থাকবে চিরটা কাল –ঠিক তখনই ঢং-ঢং-ঢং করে রাত তিনটে বেজেছিল গির্জার ঘড়িতে।
থমকে গিয়েছিল ফোদারিনগে–সর্বনাশ! এখন যে বাড়ি না ফিরলেই নয়। সকাল আটটা বাজলেই তো শুরু হবে কাজের রুটিন। বাড়িউলি মিসেস উইমসও যা খাণ্ডারনি—
অসীম শক্তির কৃপায় মি. মেডিগ তখন মিছরির মতোই মিষ্টি হয়ে গিয়েছিলেন। সুমিষ্ট বচনে উদাত্ত কণ্ঠে তাই বলেছিলেন, সে কী! এই তো কলির সন্ধে! সবে তো শুরু। দশের মঙ্গল করায় কত মজা পাচ্ছেন, সেটা বলুন? কাল ঘুম থেকে উঠে সবাই যখন দেখবে।
কিন্তু
আচমকা ফোদারিনগের বাহু খামচে ধরেছিলেন মি. মেডিগ। জ্বলজ্বল করে উঠেছিল দুই চক্ষু–তাড়াতাড়ি কীসের ভায়া? বলেই আঙুল তুলে মধ্যগগনের চাঁদ দেখিয়ে নিঃসরণ করেছিলেন একটাই শব্দ–জোশুয়া!
জোশুয়া? ফোদারিনগে তো ভ্যাবাচ্যাকা। মুশার উত্তরাধিকারী হিব্রু নায়ক জোশুয়ার কথা উঠছে কেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, জোশুয়া! থামান চাঁদকে!