আশ্চর্য! অবিশ্বাস্য! আপনি… আপনি…
যা ইচ্ছে বলব, ঠিক তা-ই হবে। দেখবেন?–ওহে মাছের গামলা, পায়রা হও তো বাপু!
পরক্ষণেই ঘরময় উড়ে বেড়িয়েছিল একটা নীল রঙের পায়রা। গোঁত খেয়ে খেয়ে গায়ের ওপর আছড়ে পড়া পাশ কাটিয়ে গেছেন মি. মেডিগ। দেখে, আবার হুকুম ঝেড়েছিল ফোদারিনগে। পায়রা নিশ্চল হয়ে ভেসেছিল শূন্যে। আবার হুকুম দিতেই পায়রা ফিরে এসেছিল টেবিলে ফুলের তোড়া হয়ে। পরের হুকুমেই দেখা গিয়েছিল কোথায় ফুলের তোড়া–এ যে সেই তামাকের বয়েম–মি. মেডিগের অতিপ্রিয় নেশার বস্তু।
শেষের দিকের মির্যালগুলো নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ করে গিয়েছিলেন মি. মেডিগ। তামাকের বয়েম পুনরাবির্ভূত হওয়ার পর দ্বিধাগ্রস্তভাবে তুলে নিয়ে পরখ করে ফের নামিয়ে রেখেছিলেন টেবিলে। বাঃ। বিস্ময়োক্তি ছাড়া আর কোনও শব্দ নিঃসৃত হয়নি। বদনগহ্বর থেকে। ফোদারিনগে তখন নিবেদন করেছিল লং ড্রাগন পানশালার লহ্মকাণ্ড থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি ঘটনা। তৃতীয় ডিমের আবির্ভাব পর্যন্ত শুনেই হাত বাড়িয়ে মি. মেডিগ বাধা দিয়েছিলেন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে–সম্ভব! সম্ভব! যদিও অসম্ভব। যদিও অবিশ্বাস্য! তবুও বলব, এসবই সম্ভব। কতকগুলো ভজঘট ব্যাপার অবশ্য থেকে যাচ্ছে, সমস্যার জট আরও বাড়ছে। যেমন, এ ক্ষমতা সাধারণ মানুষের মধ্যে এতদিন কখনও দেখা যায়নি। মিরাকল ঘটানোর ক্ষমতা পরমকারুণিক তাঁদেরই দেন, যাঁরা মানুষ হিসেবে আর পাঁচজনের মতো নয়। যেমন মহম্মদ, ভারতের যোগীরা, মাদাম ব্লাটক্সি, আরগিলের ডিউক। কদাচিৎ এই ক্ষমতা পায় অসাধারণ প্রকৃতির মানুষরাই-প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের ভেতরে যে আরও গূঢ় নিয়মের অস্তিত্ব রয়েছে–তখনই বোঝা যায়। হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনি চালিয়ে যান–চালিয়ে যান!
চালিয়েই গিয়েছিল ফোদারিনগে। উইঞ্চকে ক্যালিফোর্নিয়া পাচারের কাহিনি বর্ণনা করার পর বিষণ্ণ কণ্ঠে জানিয়েছিল, ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ইচ্ছাশক্তিটা প্রয়োগ করে ফেলায় ঘটেছে। এই বিপত্তি। উইঞ্চকে সুদূর ক্যালিফোর্নিয়ায় অত তাড়াতাড়ি উড়িয়ে নিয়ে ফেলার আদৌ তার বাসনা ছিল না। কিন্তু এমন ঝাঁপাই জুড়েছিল সে, ঝোঁকের মাথায় কী বলতে কী বলে ফেলেছে। আসলে, কী বলা উচিত, আর কী বলা উচিত নয়–এই ব্যাপারটাই বারবার গুলিয়ে ফেলছে ফোদারিনগে। এই যেমন দেখা গেল মাছের গামলার ব্যাপারে। শুধু একখানা মাছ চেয়ে বসল, কিন্তু চাওয়া উচিত ছিল মাছের গামলা, শুধু গামলা নয়, কাচের হওয়া চাই! হুকুম দিতে-না-দিতে তা এত তাড়াতাড়ি ফলে যাচ্ছে যে, হুকুম ফিরিয়ে নেওয়ারও সময় পাওয়া যাচ্ছে না। উইঞ্চকে ফিরিয়ে আনাও তো এখন সম্ভব নয়। সে অবশ্য ফিরে আসতেই চাইছে। কয়েক ঘণ্টা অন্তর তা খেয়াল হতেই ফোদারিনগে নয়া হুকুম ছেড়ে তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে পূর্বাবস্থায়, স্রেফ আত্মরক্ষার তাগিদে। উইঞ্চ অবশ্য তা বুঝতেও পারছে না। হয়তো প্রতিবার ট্রেনের টিকিট কাটার পয়সা জলে যাচ্ছে, বিরাট লোকসান হয়েই চলেছে। কিন্তু এ ছাড়া আর কিছু করারও তো নেই ফোদারিনগের। ধাঁ করে এতটা পথ চক্ষের নিমেষে উড়ে যাওয়ার ফলে বাতাসের ঘষটানিতে হয়তো জামাকাপড় ঝলসে গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার পুলিশ উঞ্ছ আকৃতির উইঞ্চকে নিশ্চয় গারদে পুরে রেখেছে। সম্ভাবনাটা মনে হতেই ফোদারিনগে অবশ্য একপ্রস্থ জামাকাপড়ের অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইচ্ছাশক্তিটাকে ঠিকমতো প্রয়োগ করা নিয়ে। হুটপাট কথা বলে ফেলায় এই যে ডাইনিদের মতো, অথবা অপরাধীদের মতো কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ফেলছে ফোদারিনগে, এর জন্যে মরমে মরে রয়েছে সে।
শুনতে শুনতে ভয় ভেঙে গিয়েছিল মি. মেডিগের। অনেকটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছিলেন। ফোদারিনগেকে সান্ত্বনা এবং আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, আশ্চর্য এই শক্তিকে ডাকিনীবিদ্যা বলা যায় না কোনওমতেই, অপরাধের গন্ধও নেই এর মধ্যে। খাঁটি মিরাকল বলতে যা বোঝায়, এ হল তা-ই।
প্রশস্তি শুনেও বিষাদ কাটেনি ফোদারিনগের। উইঞ্চকে কোনওরকম ঝঞ্ঝাট না পাকিয়ে ফিরিয়ে আনা যায় কীভাবে, এই সমস্যাই তুলে ধরেছিল বারবার। মি. মেডিগ কিন্তু উইঞ্চ সমস্যা নিয়ে তখনকার মতো মাথা ঘামাতে চাননি। ফোদারিনগের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষটাকে নিয়ে আগে ভাবনাচিন্তা করা দরকার। আশ্চর্য এই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগপদ্ধতি সম্পর্কে গবেষণা দরকার। ক্ষমতাটা যে অপরিসীম, তা তো দেখাই যাচ্ছে। অনেক অদ্ভুত কাণ্ডই ঘটানো যায় এই ক্ষমতা দিয়ে, আগে সেইগুলোই দেখা যাক। তারপরে এইভাবেই শুরু হয়ে গেল অবিশ্বাস্য কার্যপরম্পরা। শুরু হল গির্জার ঠিক পেছনেই মি. মেডিগের নিরিবিলি কক্ষে, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর রবিবার রাত্রে। মি. মেডিগ প্রেরণা এবং উৎসাহ জুগিয়ে গেলেন এবং ফোদারিনগে মির্যাল-এর পর মিরাকল ঘটিয়ে চলল। তারিখটার দিকে পাঠক-পাঠিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে বিশেষভাবে। এই কাহিনির কিছু অংশ আপত্তিকর মনে হতে পারে তাঁদের কাছে। কাগজে কিছু কিছু বিবরণ বেরিয়েছিল, পড়েও থাকতে পারেন। যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভয়ংকর দুর্ঘটনায় মারাও হয়তো গিয়েছিলেন বছরখানেক আগে। কাহিনি পড়তে পড়তেই যে কোনও সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন পাঠক অথবা পাঠিকা বুঝতে পারবেন, ঘটনাগুলো দুর্ঘটনা হলেও অপ্রত্যাশিত নয়, অবিশ্বাস্যও নয়। কাহিনিও শেষ হয়ে গেল, এমন ধারণাও করে বসবেন না দয়া করে। বরং বলা যেতে পারে, এই তো সবে জমে উঠল কাহিনি। দুই অলৌকিক ঘটনাবাজ পরমোৎসাহে নিভৃত প্রকোষ্ঠে বসে গোড়ার দিকে যেসব অলৌকিক ঘটনাগুলো ঘটিয়েছিল, তা নিতান্তই মামুলি এবং বৈচিত্রহীন, ছোট ছোট মির্যাকল। থিয়োসফিস্টদের মির্যালের মতোই অকিঞ্চিত্বর, শূন্য থেকে কাপ-ডিশ আনা অথবা বারান্দা সাজানোর জিনিসপত্র বানিয়ে নেওয়ার মধ্যে পিলে-চমকানো ব্যাপার না থাকলেও মি. মেডিগের পিলে চমকে গিয়েছিল প্রতিবারেই। ফোদারিনগে যতবারই উইঞ্চ-ঘটিত ব্যাপারটার সুচারু নিষ্পত্তি চেয়েছে, ততবারই বাধা দিয়ে বিষয়ান্তরে চলে গেছেন মি. মেডিগ। ডজনখানেক এই ধরনের ছোটখাটো অলৌকিক ঘটনাবলি সংঘটিত করার পর একটা সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগ্রহ দেখা গিয়েছিল মি. মেডিগের।