জিপ শুধু দেখল, কথা বলল না।
বেশ কিছুক্ষণ কেউ কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারিনি।
তারপর জিপ বলেছিল বিষম উচ্ছ্বাসে, বাবা, দোকান বটে–খাঁটি ম্যাজিক!
ধুত্তোর ম্যাজিক! ছেলেটার গায়ে আঁচড় লেগেছে কি না, মনটা ঠিকঠাক আছে কি না, আগে তো সেইটা দেখি। সন্ধানী চোখে দেখেও গোলমাল কোথাও দেখলাম না। ছেলে আমার ঠিকই আছে, বরং বেশ ফুর্তিতেই আছে–বৈকালিক প্রমোদ উপভোগ করেছে মনপ্রাণ দিয়ে। বগলে রয়েছে চার-চারখানা প্যাকেট।
কিন্তু কী আছে প্যাকেটের মধ্যে?
মুখে বলেছিলাম, ছোটদের রোজ রোজ যেতে নেই এ ধরনের দোকানে।
চুপ করে রইল জিপ। নিরুচ্ছ্বাস, নিরুত্তাপ। যা ওর স্বভাব। হু-হুঁ করে উঠেছিল মনটা। সেই মুহূর্তে ওর মা যা করত, আমিও তা-ই করেছিলাম। হঠাৎ হেঁট হয়ে চুমু খেয়েছিলাম ওর কপালে। হাজার হোক, ছেলেটা তো মজা পেয়েছে, আমি না-ই বা পেলাম!
প্যাকেটগুলো পরে খোলার পর আশ্বস্ত হয়েছিলাম পুরোপুরি। তিনটে বাক্সের মধ্যে সিসের সৈন্য। মামুলি খেলনা। কিন্তু ভারী সুন্দর দেখতে। এত সুন্দর যে, জ্যান্ত সৈন্য না পাওয়ার দুঃখ ভুলে গিয়েছিল জিপ। চতুর্থ বাক্সটায় ছিল কিন্তু একটা জ্যান্ত বেড়ালছানা। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। যেমন স্বাস্থ্য, তেমনি খিদে। মেজাজি নয় মোটেই।
হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম প্যাকেট চারটের জিনিসপত্র দেখে। তারপরেও অবশ্য মন না চাইলেও আপনা থেকেই পা চলে যেত ওর খেলাঘরের দিকে, ঘুরঘুর করতাম আশপাশে…
এ ঘটনা ঘটেছিল ছমাস আগে। এই ছমাসের মধ্যে উদ্ভট কিছু না ঘটায় মনের মধ্যে আর কোনও অস্বস্তি বোধ করিনি। সব বেড়ালছানার মধ্যে অল্পবিস্তর ম্যাজিক থাকে, ব্যতিক্রম দেখিনি এই বেড়ালছানার ক্ষেত্রেও। ম্যাজিকের নামগন্ধ পাইনি তিন বাক্স সিসের সৈন্যদের মধ্যে। খেলনা হিসেবে অতুলনীয়।
কিন্তু হুঁশিয়ার ছিলাম জিপকে নিয়ে। বুদ্ধিমান বাপ-মা মাত্রই ছেলেকে চোখে চোখে রাখে এমতাবস্থায়
একদিন জিজ্ঞেসও করেছিলাম, জিপ, ধর তোর সৈন্যগুলো জ্যান্ত হয়ে গিয়ে যদি কুচকাওয়াজ করতে আরম্ভ করে দেয়, কী করবি তখন?
করেই তো, ডালাটা খোলবার আগে শুধু ফুসমন্তরটা বলে দিই, সরলভাবে বলেছিল জিপ।
বাস? সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় কুচকাওয়াজ?
নইলে কি এত ভালোবাসতাম?
চমকে ওঠাটা স্বাভাবিক। উঠেছিলাম।
তারপর বেশ কয়েকবার জানান না দিয়ে হুট করে ঢুকে পড়েছিলাম ওর খেলাঘরে। দেখেছিলাম, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৈন্যরা। কিন্তু ম্যাজিক আচরণ কারও মধ্যে দেখিনি ক্ষণেকের জন্যেও। টাকাকড়ির ব্যাপারটা এবার বলা যাক। দেনা মিটিয়ে দেওয়ার বদভ্যেসটা আমার মজ্জাগত। ম্যাজিক দোকানের খোঁজে রিজেন্ট স্ট্রিটে বহুবার হানা দিয়েছি, হতাশ হয়েছি প্রতিবারেই। তবে, দোকানদার যখন জিপের নাম-ঠিকানা জেনে বসে আছে, তখন আশা আছে, একদিন-না-একদিন বিলটা পৌঁছাবেই, দামটাও মিটিয়ে দেব। টাকাকড়ির ব্যাপারটা তাই ছেড়ে দিয়েছি ম্যাজিশিয়ান মহাশয়ের মর্জির ওপর।
জীবন্ত স্বপ্ন
জীবন্ত স্বপ্ন ( A Dream of Armageddon)
[‘A Dream of Armageddon’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Black and White’ পত্রিকায় জুন ১৯০১ সালে। পরে ‘Thomas Nelson and Sons’ থেকে ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘The Country of the Blind and Other Stories’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়।]
লোকটাকে দেখেছিলাম রাগবি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। সাদা নিরক্ত মুখ। শ্লথ চরণ। কুলির দরকার, কিন্তু হেঁকে ডাকছে না কুলিকে। খুবই অসুস্থ মনে হয়েছিল। তাই চেয়েছিল একদৃষ্টে। পা টেনে টেনে এসে বসে পড়েছিল আমার পাশে। পাঁজর গুড়ো করে যেন বেরিয়ে এসেছিল দীর্ঘশ্বাসটা। গায়ের শালটা কোনওমতে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে শূন্য চাহনি মেলে তাকিয়েছিল অন্যদিকে। একটু পরেই অস্বস্তি জাগ্রত হয়েছিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, আমার নিষ্পলক চাহনি তার ওপরেই নিবদ্ধ রয়েছে বুঝতে পেরে। বারেক তাকিয়েছিল আমার দিকে। পরক্ষণেই ফের চোখ মেলেছিল আমার ওপর।
বই পড়ে যাওয়ার ভান করেছিলাম আমি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে বিড়ম্বনায় ফেলেছি, এই আশঙ্কায় আর তার দিকে তাকাইনি। অবাক হয়েছিলাম একটু পরেই। কী যেন সে বলছিল আমাকে।
কিছু বলছেন? জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।
আঙুল তুলে আমার হাতের বইটা দেখিয়ে সে বলেছিল, স্বপ্ন সংক্রান্ত বই, তা-ই না?
নিশ্চয়, ড্রিম স্টেটস নামটা তো প্রচ্ছদেই লেখা রয়েছে।
চুপ করে ছিল সে কিছুক্ষণ। যেন বলার মতো কথা খুঁজছে মনের মধ্যে। তারপর বলেছিল আত্মগত স্বরে, কিন্তু ওরা তো কিছু বলবে না আপনাকে।
মানে বুঝলাম না। তাই নীরব রইলাম।
সে বললে, জানলে তো বলবে।
খুঁটিয়ে দেখছিলাম তার মুখচ্ছবি। সে বলেছিল, স্বপ্ন আছে বইকী–বিলক্ষণ আছে।
এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করি না আমিও।
দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে সে তখন বলেছিল, স্বপ্ন দেখেন? মানে, জীবন্ত স্বপ্ন?
বলেছিলাম, স্বপ্নই দেখি কম। বছরে তিনটেও হয় কি না সন্দেহ।
আবার চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল সে। যেন কথা সাজাচ্ছে মনের মধ্যে।
তারপরেই প্রশ্ন করেছিল আচমকা, স্মৃতি আর স্বপ্ন কি তালগোল পাকিয়ে যায়? স্বপ্ন আদৌ সত্যি বলে মনে হয় কখনও?
কদাচিৎ। ক্ষণেকের জন্যে দ্বিধা জাগে মাঝেমধ্যে। সবারই তা-ই হয়।