যতখানি সম্ভব এড়িয়ে চলছিলাম। কিন্তু কানে ছিপি দিয়ে তো থাকা যায় না। ম্যাজিক দোকানদার যখন যে জাদু-শব্দ উচ্চারণ করছে, চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে হুবহু সেই ঢঙে সেই উচ্চারণে তার পুনরাবৃত্তি শুনছি কচি গলায়! কান সেদিকে থাকলেও মন সরে গিয়েছিল অন্যদিকে৷ শোরুমের বিশালতা এবং মজাদার পরিবেশ সম্বন্ধে আগেই বলেছি। মজা এখানে সর্বত্র। এমনকী কড়িকাঠ, মেঝে, পরদাগুলোতেও। এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা চেয়ারগুলোর মধ্যেও রয়েছে মজা, শুধুই মজা। কেন জানি না বারবার মনে হচ্ছিল, যখনই চেয়ারের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেছি, তখনই যেন চেয়ারগুলো আপনা থেকেই নড়েচড়ে জায়গা বদল করে নিচ্ছিল। নিঃশব্দে চলেছে এই খেলা আমার দুপাশে, আমার পেছনে। সবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে কিন্তু আর কোনও চেয়ারকে জীবন্ত অবস্থায় দেখিনি। এ ধরনের অদ্ভুত মজা মোটেই ভালো লাগেনি আমার। ঘরের ওপরকার কার্নিশে দেখেছিলাম এমন একটা কিলবিলে সর্পিল নকশা, যা আমার রুচি মেনে নিতে পারেনি কোনওমতেই। তার চাইতে বিদঘুটে, সর্পিল হল, কার্নিশ থেকে ঝোলানো সারি সারি কিম্ভুতকিমাকার মুখোশগুলো–নিছক প্লাস্টারে কি অমন ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব?
আচমকা আকৃষ্ট হয়েছিলাম অদ্ভুতদর্শন এক সহকারীর বিটকেল কার্যকলাপ দেখে। স্থূপাকার খেলনার আড়ালে থাকায় সে নিশ্চয় দেখেনি আমাকে, আমি দেখতে পেয়েছিলাম তার শরীরের তিন-চতুর্থাংশ। একটা থামে হেলান দিয়ে অলসভাবে খেলা করছিল নিজের নাকখানাকে নিয়ে অত্যন্ত বীভৎসভাবে! নেই কাজ তো খই ভাজ ভাব নিয়ে সময় কাটানো ঢঙে নিজের গোদা মোটকা নাকখানাকে হঠাৎ দূরবিনের মতো লম্বা করে ফেলেও ক্ষান্ত হয়নি। আরও মজা করার জন্যে ক্রমশ সরু করে ফেলেছিল নাকের ডগা। দেখতে দেখতে লাল রঙে ছোপানো চাবুকের মতো ইয়া লম্বা একখানা নাক সপাং সপাং করে বাতাস আছড়ে গিয়েছিল নিজের খেয়ালে। অতি বড় দুঃস্বপ্নেও যে এমন দৃশ্য দেখা যায়। না! থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চাবুকের মতো হাঁকড়ে চলেছে হিলহিলে লম্বা নাক। কী ভয়ানক! কী ভয়ানক!
দেখেই তো আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল আমার। এস্তে তাকিয়েছিলাম জিপের দিকে– ভয়ানক এই অবসর বিনোদন যেন সে বেচারির চোখে না পড়ে। দেখলাম, একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে ষড়যন্ত্রকারীর মতো সে ফিসফিস করে কথা বলছে। দোকানদারের সঙ্গে। দোকানদারও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হাতে একটা পেল্লায় ড্রাম।
চোখাচোখি হতেই সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠেছিল জিপ, লুকোচুরি খেলা, বাবা! লুকোচুরি খেলা!
বাধা দেওয়ার আগেই মাথার ওপর দিয়ে ড্রামখানা গলিয়ে দিয়েছিল দোকানদার।
সঙ্গে সঙ্গে দাবড়ানি দিয়েছিলাম তারস্বরে, ও কী হচ্ছে? ভয় দেখাচ্ছেন কেন ছেলেটাকে? তুলুন–এখুনি তুলুন!
দ্বিরুক্তি না করে অসম কর্ণের দোকানদার তুলে নিয়েছিল ড্রাম–ঘুরিয়ে ধরেছিল আমার দিকে। শূন্য ড্রাম। টুলও শূন্য! মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেছে আমার পুত্র!…
অদৃশ্যলোক থেকে অশুভশক্তি যদি হাত বাড়িয়ে কারও হৃৎপিণ্ড খামচে ধরে অকস্মাৎ, তখন তার মনের যা অবস্থা হয়–আমারও হল তা-ই। নিজস্ব সত্তা বলে যেন আর কিছুই রইল না। কাঠ হয়ে গেলাম। ধড়ফড় করতেও ভুলে গেলাম। রাগ বা ভয় কোনও বোধশক্তিই আর রইল না।
লম্বা লম্বা পা ফেলে দেঁতো হাসি-হাসা দোকানদারের সামনে গিয়ে লাথি মেরে সরিয়ে দিলাম টুলখানা।
বললাম দাঁতে দাঁত পিষে, কোথায় গেল আমার ছেলে?
দুহাতে শূন্য ড্রামখানা আমার দিকে ফিরিয়ে বললে সে, দেখতেই পাচ্ছেন, লোক ঠকানো কারবার আমরা করি না—
হাত বাড়িয়েছিলাম কাঁধখানা খামচে ধরব বলে। কিন্তু সাঁত করে পিছলে গেল সে নাগালের বাইরে। আবার তেড়ে গেলাম কাঁধ খামচানোর জন্যে। বিদ্যুৎগতিতে ছিটকে গিয়ে সে একটা দরজা খুলে ধরল সটকান দেওয়ার মতলবে। চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠেছিলাম পেছন থেকে, দাঁড়ান… দাঁড়ান বলছি! বলেই ক্ষিপ্তের মতো ধেয়ে গিয়েছিলাম তাকে ধরতে গিয়ে পড়লাম নিঃসীম অন্ধকারের মধ্যে।
ধপ করে একটা আওয়াজ ভেসে এল কানে। কে যেন সশব্দে আছড়ে পড়েছে আমার গায়ের ওপর।
বিমূঢ় অবস্থায় শুনেছিলাম তার ক্ষমা প্রার্থনা–মাপ করবেন। দেখতে পাইনি।
দেখলাম, দাঁড়িয়ে আছি রিজেন্ট স্ট্রিটে। ধাক্কা লেগেছে একজন ভদ্রবেশী শ্রমিকের সঙ্গে। গজখানেক দূরে হতচকিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে জিপ। আমাকে দেখেই কাষ্ঠ হেসে এসে দাঁড়াল পাশে।
বগলে রয়েছে চারখানা প্যাকেট!
ঝকঝকে হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলে মুঠোয় চেপে ধরেছিল আমার একখানা আঙুল। ফ্যালফ্যাল করে আমি কিন্তু তখন ইতিউতি চেয়ে দেখছি। কই, ম্যাজিক দোকানের দরজা তো দেখা যাচ্ছে না! দোকানের চিহ্নও তো কোথাও নেই! ছবির দোকানটা আছে, মুরগিছানার দোকানটা কাছে–ম্যাজিকের দোকানটা গেল কোথায়?
মাথার মধ্যে এইরকম লন্ডভন্ড অবস্থায় একটাই করণীয় ছিল–ফুটপাতের কিনারায় গিয়ে ছাতা তুলে হাঁক দিলাম একটা ছ্যাকড়া গাড়িকে। জিপকে ধরে তুলে দিলাম গাড়ির মধ্যে। অতি কষ্টে মনে করলাম নিজের বাড়ির ঠিকানা, তারপর উঠে বসলাম জিপের পাশে। কোটের পকেটে কী যেন একটা ঠেলে রয়েছে দেখে হাত ঢোকাতেই পেলাম একটা কাচের বল। টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম রাস্তায়।