আরও রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল পাজির পা-ঝাড়া দোকানদারের চোখে-মুখে। খাটো গলাতেই বলেছিল বিষম বিস্ময় প্রকাশ করে, সে কী! ও জিনিস তো এ দোকানের নয়! বাইরে থেকে এসে পড়েছে–আপনিই এনেছেন হয়তো জামা-প্যান্টের মধ্যে। পরের কথাটা নিক্ষিপ্ত হল জিপের উদ্দেশে, খোকা, মনের মতো আর কী দেখতে চাও বল দিকি?
অনেক কিছুই তো দেখতে চায় জিপ–এ দোকানের সবই তো দেখছি ওর মনের মতোই। প্রশ্নটা শুনেই সসম্ভমে তাকিয়েছিল নচ্ছার দোকানদারের দিকে–দুচোখে ফুটে উঠতে দেখেছিলাম ম্যাজিকের ব্যাপারে লোকটার ওপর অপরিসীম আস্থা। বলেছিল সশ্রদ্ধ সুরে, ওটা কি ম্যাজিক তলোয়ার?
খেলনা ম্যাজিক তলোয়ার। বাঁকে না, ভাঙে না, আঙুল কেটেও যায় না। এ তলোয়ার যার কাছে থাকে, আঠারো বছরের নিচে যে কোনও শত্রুকে সে হারিয়ে দিতে পারে তলোয়ার যুদ্ধে। যেমন সাইজ, তেমন দাম। আধ ক্রাউন থেকে সাড়ে সাত পেনি পর্যন্ত। আর এই যে কার্ডের তৈরি ফুল সেট বর্ম দেখছ, এগুলো বাচ্চা নাইট-যোদ্ধাদের খুবই দরকার। এই ঢাল নিয়ে তলোয়ার যুদ্ধে নামলে শত্রুর তলোয়ার গায়ে লাগবে না, এই চটি পায়ে গলালে বিদ্যুৎবেগে শত্রুকে হারিয়ে দেবে, এই শিরস্ত্রাণ মাথায় পরলে কার সাধ্যি তোমার মাথায় তলোয়ারের কোপ মারে।
শুনে যেন দম আটকে এল জিপের–বাবা!
অর্থাৎ এমন জিনিস না কিনলেই নয়। দাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু আমার কোনও কথাতেই কান দেয়নি দোকানদার। জিপকে বেশ কবজায় এনে ফেলেছে ততক্ষণে; জিপ আমার আঙুল ছেড়ে তার আঙুল খামচে ধরে শোরুম ভরতি অজস্র বিদঘুটে জিনিসপত্রের আশপাশ দিয়ে দিব্যি ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে। জিপকে ফেরানোর সাধ্যি তখন আমারও নেই। দেখে মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিল আমার। একটু ঈর্ষাও হয়েছিল। জিপ এত সহজে আমার আঙুল ছেড়ে আর-একজনের আঙুল ধরে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়াবে, ভাবতেও পারিনি। লোকটার অনেক গুণ আছে মানছি, ছেলেপুলে তো বটেই, তাদের বাবাদের মনেও চমক সৃষ্টি করতে পারে, চক্ষু চড়কগাছ করে দেওয়ার মতো নকল সামগ্রীও বানাতে ওস্তাদ, তা-ও মানছি, তবুও
কথা না বাড়িয়ে অগত্যা ওদের পেছনেই লেগে ছিলাম আঠার মতো। বিশেষ করে নজর রেখেছিলাম হাতসাফাইয়ের জাদুকরটার ওপর। জিপ আনন্দ পাচ্ছে, এটাই বড় কথা। সময় হলেই বাপ-বেটায় বেরিয়ে পড়ব দোকানের বাইরে।
শেষ নেই যেন শোরুমের। টানা লম্বা প্রদর্শনী মঞ্চের পর প্রদর্শনী মঞ্চ। জাদুসামগ্রীর বীথি বলা যায়। ম্যাজিক গ্যালারি, থাম, তাক আর কাউন্টার যেন আর ফুরাচ্ছে না। একটা খিলেন শেষ হয় তো আরম্ভ হয় আর-একটা। একটা ডিপার্টমেন্টের শেষে পৌঁছাতেই দেখি ধনুকাকৃতি নতুন ভিলেনের তলায় আর-একটা ডিপার্টমেন্ট। অদ্ভুত বিটকেল কিম্ভুতকিমাকার সহকারীরা প্যাটপ্যাট করে চেয়ে রয়েছে থাম, তাক আর কাউন্টারের আড়াল থেকে। এরকম কিম্ভুতদর্শন সহকারীর দল জীবনে দেখিনি মশায়। সারি সারি বিচিত্র দর্পণে নিজের রকমারি প্রতিবিম্ব দেখছি আর চমকে চমকে উঠছি। পরদার বাহারই বা কতরকম। ধাঁধা সৃষ্টি করে চলেছে বিরামবিহীনভাবে। চোখের ধাঁধা থেকে মনের ধাঁধা। শেষ পর্যন্ত পরদা আর আয়নার গোলকধাঁধায় বনবন করে মাথা ঘুরতে লাগল আমার। কোন দরজা দিয়ে ঢুকেছিলাম আশ্চর্য এই শোরুমের ভেতরে, কোনদিকে যে তা আছে, সে হিসেবও হারিয়ে ফেলেছিলাম।
জিপকে ম্যাজিক ট্রেন দেখিয়েছিল দোকানদার। ম্যাজিকই বটে। বাষ্পে চলে না সে ট্রেন, ঘড়িযন্ত্রের মতো দম দেওয়ার কারবারও নেই। সিগন্যালগুলো যেখানে যা দরকার, কেবল বসিয়ে দিলেই হল, কু-ঝিকঝিক করে গড়িয়ে চলবে জাদু রেলগাড়ি। তারপরেই জিপকে দেখানো হল ভীষণ দামি বাক্স ভরতি সৈনিক। জ্যান্ত সৈন্যরা গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে আসবে বাইরে ডালাটা খুলে ধরে একটা দাঁত-ভাঙা মন্ত্র বললেই। একবার শুনেই সে মন্ত্র মনে রাখার মতো কান আমার নেই। কিন্তু জিপ পেয়েছে ওর মায়ের মতো ধারালো কান। নিমেষে আওড়ে গেল ভজকট মন্ত্রটা। পিঠ চাপড়ে দিয়ে দোকানদার সৈন্যদের দুমদাম করে ছুঁড়ে ঢুকিয়ে দিলে বাক্সের মধ্যে এবং গোটা বাক্সটা তুলে দিলে জিপের হাতে। খোকা, এবার তোমার পালা। জাগাও সৈন্যদের, দোকানদারের মুখ থেকে কথাটা খসতে না-খসতেই মন্ত্র আওড়ে জ্যান্ত সৈন্যদের বাক্সের বাইরে বার করে এনেছিল জিপ।
নেবে নাকি? দোকানদারের প্রশ্ন।
জবাবটা দিয়েছিলাম আমি, নেব বইকী, কিন্তু পুরো দাম নিতে হবে আপনাকে। চুম্বকটাও দিয়ে দেবেন সেই সঙ্গে
কী যে বলেন! বলেই দুমদাম করে সৈন্যদের আবার বাক্সের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে ডালা বন্ধ করে গোটা বাক্সটাকে শূন্যে দুলিয়ে নিতেই চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল আমার। শূন্যপথেই বাদামি কাগজে প্যাকিং হয়ে গেছে বাক্স, সুতো দিয়ে বাঁধাও হয়ে গেছে, এমনকী লেবেলের ওপর জিপের পুরো নাম-ঠিকানা পর্যন্ত লেখা হয়ে গেছে!
আমার ছানাবড়া চক্ষু দেখে সে কী হাসি দোকানদারের।
বলেছিল হাসতে হাসতেই, খাঁটি ম্যাজিক, স্যার। ভেজালের কারবার নেই এ দোকানে।
বিড়বিড় করে বলেছিলাম, এত খাঁটি ম্যাজিক আমার রুচিতে সয় না।
কথাটা বললাম যাকে লক্ষ্য করে, সে কিন্তু ততক্ষণে জিপকে আরও অদ্ভুত অদ্ভুত ম্যাজিকের কায়দা দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। প্রতিটা ম্যাজিকই অদ্ভুত, তার চাইতেও অদ্ভুত হাতসাফাইয়ের কায়দা। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে দোকানদার, গাম্ভীরি চালে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যাচ্ছে জিপ।