আচমকা স্তব্ধ হল কণ্ঠস্বর। যেন গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে পিন ঠিকরে গেল ইটের ঠোক্করে।
আর কোনও কথা নেই।
কাগজের খসখসানিও নেই।
থমথমে নীরবতা।
টুপির কাজ শেষ হল? জানতে চেয়েছিলাম গলাখাঁকারি দিয়ে। জবাব নেই।
দৃষ্টিবিনিময় করেছিলাম আমি আর জিপ। বিদঘুটে আয়নাগুলোয় দেখেছিলাম বাপ বেটার বিদঘুটে প্রতিবিম্ব–দুজনেরই চোখ বড় বড়।
জিপ কিন্তু রীতিমতো গম্ভীর। শান্ত। নির্বিকার।
হেঁকে বলেছিলাম আমি, এবার যাওয়া যাক। ও মশাই, দাম কত হল?
সাড়া নেই।
গলা চড়িয়েছিলাম, দয়া করে ক্যাশ মেমোটা এবার দিন।
তাচ্ছিল্যের নাসিকাধ্বনি যেন শুনলাম কাগজের ডাঁইয়ের আড়ালে?
জিপকে বলেছিলাম, চল তো দেখি কাউন্টারের ওদিকে–নিশ্চয় লুকিয়ে আছে–মজা করছে।
বাঘটা কিন্তু সমানে মাথা দুলিয়েই যাচ্ছিল এত কাণ্ডের মধ্যে। তার পাশ দিয়ে গেলাম কাউন্টারের ভেতরে। কী দেখলাম জানেন? কাউকে না! মেঝের ওপর কেবল পড়ে রয়েছে আমার টুপিটা। পাশেই বসে একটা খরগোশ। ম্যাজিশিয়ানদের খরগোশদের মতোই বোকা-বোকা চেহারা। কিন্তু ভাবখানা যেন বড় কঠিন সমস্যায় পড়েছে–ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না। আমি টুপি তুলে নিতেই তিন লাফ মেরে চলে গেল চোখের বাইরে।
বাবা! ফিসফিস করে বলেছিল জিপ।
কী রে?
কী সুন্দর দোকান বাবা, খু-উ-উ-ব ভালো লাগছে।
ভালো তো আমারও লাগছে রে। মনে মনেই বলেছিলাম আমি, আরও ভালো লাগত, যদি কাউন্টারটা হঠাৎ নিজে থেকেই লম্বা হয়ে না গিয়ে দরজার পাল্লাটা এঁটে ধরত। মুখে কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ করলাম না, পাছে জিপের নজর সেদিকে গিয়ে পড়ে। অদ্ভুত কাণ্ডটা ওর না দেখাই ভালো।
জিপের নজর তখন অবশ্য খরগোশটার দিকে। লাফাতে লাফাতে পাশ দিয়ে সরে পড়বার মতলবে রয়েছে। জিপ কি অত সহজে ছাড়ে? আদুরে গলায় বললে, এই পুসি, জিপকে একটা ম্যাজিক দেখাবি না? পুসির বয়ে গেছে ম্যাজিক দেখাতে! টুকুস টুকুস করে লাফ দিয়ে সুড়ত করে গলে গেল পাশের একটা দরজা দিয়ে।
অবাক কাণ্ড! এ দরজা তো একটু আগেও চোখে পড়েনি আমার! হলফ করে বলতে পারি, ছোট্ট ঘরখানায় এ দরজা ছিল না। এল কোত্থেকে?
আচমকা ঈষৎ ফাঁক হয়ে-থাকা পাল্লাটা খুলে গেল দুহাট হয়ে–নিঃশব্দে বিটকেল হাসি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল দোকানদার স্বয়ং–যার একটা কান আর-একটা কানের চেয়ে। বেশি লম্বা। হাসিটা দেখে পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল আমার। কেননা, এ হাসি নিছক আমুদে হাসি নয়, সেই সঙ্গে মিশে আছে যেন একটু বেপরোয়া ভাব–যেন আমাকে তোয়াক্কা না করার ভাব–ম্যাজিক জিনিসটার প্রতি আমার অবিশ্বাসী মনোভাবটাকে যেন নস্যাৎ করার মনোভাব। বিচ্ছিরি হাসিটা ঠোঁটের কোণে বিচ্ছিরিভাবে দুলিয়ে রেখেই বলেছিল রহস্যময় জাদুকর, স্যার, শোরুমটা দেখতে চান তো? এমন মসৃণভাবে প্রস্তাবটা রাখল সামনে যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। আঙুলের ওপর জিপের টান অনুভব করলাম– হঠাৎ-আবির্ভূত দরজার দিকে টানছে আমাকে। দৃষ্টি ফেরালাম ভূতুড়ে কাউন্টারটার দিকে পরক্ষণেই চোখাচোখি হয়ে গেল দোকানদারের সঙ্গে। ম্যাজিক জিনিসটা ততক্ষণই মজাদার থাকে, যতক্ষণ তা খাঁটি জাদুবিদ্যা না হয়ে যায়। এখানে যেন বড় বেশি অলৌকিক খেলা দেখে ফেলছি। গা শিরশির করছিল সেই কারণেই। তাই বলেছিলাম, হাতে বেশি সময় নেই। কিন্তু মুখের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দেখি, কীভাবে জানি না, চৌকাঠ পেরিয়ে পৌঁছে গেছি শোরুমের মধ্যে।
আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখচ্ছবি নিরীক্ষণ করতে করতে দোকানদার তখন পরম আয়েশে ঘষছে নিজের দুহাত। হাত তো নয়, যেন রবার দিয়ে তৈরি।
আঙুল-টাঙুলগুলোয় গাঁট-ফাঁটের বালাই নেই বললেই চলে। কথা বলছে যেন মিছরির রসে ডুবিয়ে ডুবিয়ে, বিলকুল খাঁটি ম্যাজিকের জিনিসপত্র, স্যার–নকলি মাল এখানে একটাও নেই।
হারামজাদা! মনে মনেই বলেছিলাম আমি। কিন্তু মুখে তা ব্যক্ত করা সমীচীন নয়। ওই জাতীয় কোনও শব্দ মুখ দিয়ে বার করার আগেই অবশ্য কোটের হাতা ধরে কে যেন টানাটানি আরম্ভ করে দিয়েছিল। চোখ নামিয়েই দেখেছিলাম, একটা লেজওয়ালা লাল রঙের বিটলে বামন-দৈত্য টানাটানি করছে আমার কোটের হাতা ধরে! দোকানদার ধরে রয়েছে তার লম্বা লেজটা। টেনে নিয়ে আনতে চাইছে নিজের দিকে, বিটলে দৈত্যর মহা আপত্তি তাতে–কামড়ে দিতে যাচ্ছে দোকানদারের হাত। কিন্তু ভ্রূক্ষেপ বা ভয়ডর নেই। আশ্চর্য দোকানদারের। চোখের পলক ফেলার আগে অদ্ভুত কায়দায় লেজ ধরে লাল দৈত্যকে টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলে কাউন্টারের পেছনে–খুব স্বাভাবিকভাবেই অবশ্য। মুখের চামড়ায় সামান্যতম বিকৃতি বা কুঞ্চন দেখা গেল না–যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমার অবস্থা কিন্তু তখন শোচনীয়।
নিশ্চয় রবারের তৈরি দৈত্য। নাড়ালেই কিলবিল করে উঠেছে–চকিত দেখায় মনে হয়েছে জ্যান্ত দৈত্য। চক্ষুভ্রম সৃষ্টি করাই তো জাদুকরের মুনশিয়ানা। মনকে এইভাবে প্রবোধ দিলেও কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন ডিগবাজি খেয়ে এসে ঠেকেছিল গলার কাছে!
ঢোক গিলে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম লাল দৈত্যের অন্তর্ধান ঘটতেই। লোকটার হাবভাব মোটেই ভালো লাগেনি। এই ধরনের কুৎসিত কদাকার গা-ঘিনঘিনে নচ্ছার প্রাণীদের ঘাঁটাঘাঁটি যারা করে, তাদের দেখলেই যেমন গা শিরশির করে ওঠে, আমার সারা গা তখন শিরশির করছে ঠিক সেইভাবে। তাকিয়েছিলাম জিপের দিকে। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম ওর অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা দেখে। একদৃষ্টে দেখছে একটা ম্যাজিক ঘোড়া, দুলন্ত ঘোড়া। বিতিকিচ্ছিরি দৈত্যটাকে চোখে পড়েনি জেনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। চোখের ইঙ্গিতে জিপকে দেখিয়ে আর অন্তর্হিত লাল দৈত্যের দিকে ইশারা করে খাটো গলায় বলেছিলাম দোকানদারকে, আশা করি এই ধরনের সৃষ্টিছাড়া জিনিস আর নেই আপনার হেপাজতে?