খাটে বসে পায়ের বুট খুলতে খুলতে এবং নিজের মনে বকবক করতে করতে শেষকালে কিন্তু বিলক্ষণ সুখীই হয়েছিল নচ্ছার কনস্টেবলটাকে ক্যালিফোর্নিয়ায় পাচার করার সুখচিন্তায়। কীভাবে পাচার হল হতভাগা এবং তারপর কী কী ঘটবে, সেসব নিয়েও আর মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত করেনি। শুতে-না-শুতেই সে কী ঘুম! ঘুমের মধ্যে অবিশ্যি স্বপ্ন দেখেছিল উইঞ্চকে–রেগে তিনটে হয়ে এই মারে কি সেই মারে অবস্থায় তেড়ে আসছে– কিন্তু নাগাল ধরতে পারছে না ফোদারিনগের!
পরের দিন দুটো কৌতূহলোদ্দীপক সংবাদ শ্রবণ করল অঘটন ঘটনবাজ ফোদারিনগে। কে নাকি অতীব সুন্দর একটা গোলাপ ফুলের গাছ পুঁতে গেছে লুলাবরো রোডে বুড়ো গামশটের বাড়ির ঠিক সামনেই। আর, রলিং মিল পর্যন্ত নদীতে জাল ফেলা হচ্ছে কনস্টেবল উইঞ্চের মরদেহের সন্ধানে।
সেদিন বড়ই অন্যমনস্ক ছিল ফোদারিনগেমশায়। নতুন কোনও মিরাকল ঘটায়নি। উইঞ্চের জন্যে বড় মন কেমন করছিল। তাই তার নিত্যব্যবহার্য দু-একটা জিনিস আর ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের জন্যে সামান্য কিছু খাবারদাবার পাঠিয়ে দিয়েছিল হুকুমের জোরে তার বেশি কিছু নয়। মাথার মধ্যে হাজার চিন্তা ভোমরার মতো গুনগুন করে ঘুরপাক খাওয়া সত্ত্বেও দৈনিক কাজে ত্রুটি রাখেনি কোত্থাও। লোকে অবশ্য তা-ই নিয়েও হাসি মশকরা করেছে। কী জ্বালা, কী জ্বালা! ফোদারিনগে কেন এত অন্যমনস্ক, কেন এত চুপচাপ–তা নিয়ে তোমাদের অত ইয়ারকি মারবার দরকারটা কী শুনি? ভাগ্য ভালো, উইঞ্চের চিন্তায় বিভোর হয়ে ছিল ফোদারিনগে–নইলে অনুর্থর পর অনর্থ ঘটে যেত সেইদিনই। রেগেমেগে যদি কাউকে বলে বসত, গোল্লায় যাও, জাহান্নমে যাও!–তাহলে কী কাণ্ডটা হত বলুন তো? নরক জায়গাটা নিশ্চয় খুব আহামরি নয়!
রোববার সন্ধ্যা নাগাদ গির্জাতে গেল ফোদারিনগে মনের জ্বালা জুড়াতে। কী আশ্চর্য! ঠিক সেইদিনই অলৌকিক কাণ্ডকারখানা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন বিশপমশাই। নাম তাঁর মি. মেডিগ। গুপ্তবিদ্যায় তাঁর আগ্রহ ছিল বরাবরই। আইনকানুন যেসব ব্যাপারকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে শাসনে রাখে, সেইসব ব্যাপার নিয়েই অনেক কথা বলে গেলেন তিনি। কান খাড়া করে শুনে গেল ফোদারিনগে। গির্জাতে নিয়মিত সে আসে না। যেদিন এল, সেইদিনই কিনা মনের মতো বক্তৃতা! শুনে প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল। ঈশ্বরদত্ত অলৌকিক ক্ষমতাটা সম্বন্ধে নতুন দিগন্ত যেন উন্মোচিত হল বিহ্বল মনের আকাশে। ঠিক করল, বক্তৃতা শেষ হলেই দেখা করবে মি. মেডিগের সঙ্গে।
ফোদারিনগের নাস্তিকতা অবিদিত ছিল না শহরে। ভগবান-টগবান একেবারেই মানে না, ধর্ম জিনিসটা নিয়ে ফক্কড়ি করে। এহেন ছোকরা হঠাৎ কথা বলতে চায় নিরিবিলিতে–শুনে বিলক্ষণ অবাক হয়েছিলেন মি. মেডিগ। তাই সঙ্গে সঙ্গে দেখা করেননি। হাতের কাজকর্ম সেরে তাকে নিয়ে গেলেন নিজের প্রাইভেট কক্ষে। চুল্লির সামনে বসিয়ে নিজে দাঁড়ালেন দুপা ফাঁক করে খিলানের মতো ফাঁক-করা পদযুগলের ছায়া পড়ল বিপরীতদিকের দেওয়ালে। আত্মকাহিনি বলতে গিয়ে কিন্তু প্রথমদিকটায় লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল ফোদারিনগে। শুরু করবে কীভাবে, তা-ই নিয়েই পড়েছিল মহাবিড়ম্বনায়। জানি না আদৌ বিশ্বাস করবেন কি না জাতীয় দু-একটা বাক্য নিঃসরণের পর আচমকা শুধিয়েছিল মি. মেডিগকে–বলুন তো, মির্যা সম্বন্ধে আপনার কী অভিমত?
আচমকা প্রশ্ন শুনে জবাব দিতে একটু টালবাহানা করেছিলেন মি. মেডিগ। কিন্তু চেপে ধরেছিল ফোদারিগে–নেহাতই সাধারণ মানুষ আমি, দেখতেই পাচ্ছেন। কিন্তু আমার মতোই গোবেচারা একটা সত্তার ভেতরে যদি আচমকা ইচ্ছাশক্তি মাথাচাড়া দেয়, ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়, তখন আপনার কী মনে হবে বলুন তো?
অমন হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়, কায়দা করে জবাব দিয়েছিলেন মি. মেডিগ।
টেবিলের ওপর তামাকের বয়েমটা দেখিয়ে বলেছিল ফোদারিনগে, হাতেনাতে দেখিয়ে দিতে চাই, একেই মিরাকল বলে কি না। আধ মিনিট সবুর করুন প্লিজ।
বলে, কপাল কুঁচকে তাকিয়েছিল তাম্রকূট আধারের দিকে। আঙুল তুলে হুকুম দিয়েছিল বিড়বিড় করে, হও তো বাপু ভায়োলেট ফুল।
তা-ই হয়েছিল তামাকের বয়েম। পরিবর্তনটা ঘটেছিল সহসা এবং দারুণভাবে চমকে দিয়েছিল মি. মেডিগকে। ফ্যালফ্যাল করে পর্যায়ক্রমে চেয়ে ছিলেন ফোদারিনগে এবং ফুলের তোড়ার পানে। মুখে একটা কথাও বলেননি। তারপর হেঁট হয়ে ঘ্রাণ নিয়েছিলেন ফুলের। টাটকা ফুল। যেন এখুনি তুলে আনা হয়েছে বাগান থেকে।
চেয়েছিলেন ফোদারিনগের দিকে–কী করে করলেন বলুন তো?
গোঁফে টান মেরে বলেছিল ফোদারিনগে, সেইটাই জানতে এসেছি। যা দেখলেন তা কি মির্যাল, না ডাকিনীবিদ্যা? হুকুম দিয়ে অঘটন ঘটাতে পারি–দেখতেই পেলেন। কী মনে হয় আমাকে? প্রশ্ন সেইটাই–এসেছি জবাবটা জানতে।
খুবই অসাধারণ কাণ্ড।
অথচ দেখুন, এই সেদিনও এ ক্ষমতা আমার ছিল না। ইচ্ছে করলেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতাম না। গত হপ্তায় ছিলাম সাধারণ মানুষ–এখন হলাম অসাধারণ। আচমকা ক্ষমতাটা এসে গেছে ভেতরে। কোথাও একটা গোলমাল ঘটেছে, ইচ্ছাশক্তিটা হঠাৎ এমন জোরদার হয়ে উঠেছে।
এ ছাড়াও আরও কিছু করতে পারেন নাকি?
বলেন কী! যা খুশি তা-ই করতে পারি। একটু ভাবতেই অনেকদিন আগে দেখা একটা ভোজবাজি মনে পড়ে গিয়েছিল ফোদারিনগের, তর্জনীশাসনে হুকুম দিয়েছিল ফুলের তোড়াকে–মাছ হয়ে যাও–না, না, লাল মাছ ভরতি গামলা হয়ে যাও–কাচের গামলা। বাঃ, এই তো চাই! দেখলেন?