আহা, রগুড়ে লোক তো! রঙ্গরসিকতায় বিলক্ষণ পোক্ত।
জিপের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত অমায়িক হাসি হাসল লোকটা, মূর্তিমান শিষ্টাচার বললেই চলে। বললে, খোকা, বড় ভালো ছেলে তুমি।
জিপ যে সত্যিই ভালো ছেলে, এ তথ্যটাও লোকটা জেনে বসে আছে দেখে অবাক হয়েছিলাম বিলক্ষণ। বাড়িতেও ব্যাপারটা গোপন রেখেছি নিছক নিয়মানুবর্তিতার খাতিরে। জিপের কানে যেন না যায়। কিন্তু এ লোকটা…।
জিপ কিন্তু তিলমাত্র সপ্রতিভ হল না। উচ্ছ্বাস প্রকাশও করল না। নিরেট নীরবতায় ঢেকে রেখে দিল নিজেকে। পলকহীন চক্ষু নিবদ্ধ রইল অদ্ভুত দোকানের বিচিত্র দোকানদারের ওপর।
ভালো ছেলেরাই শুধু এ দোকানের চৌকাঠ পেরতে পারে–আর কেউ না৷
কথাটা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, তার উদাহরণস্বরূপ সহসা দোকানের বাইরে ছিচকাঁদুনে বায়না শুনলাম বালক-কণ্ঠে। ঘ্যানঘ্যান করছে বাবার কাছে। অচিরেই দেখা গেল তাকে কাচের মধ্যে দিয়ে। চকোলেট খাওয়া গোবদা চেহারা, নিরক্ত সাদাটে মুখ, চাই-চাই ভাব চোখে-মুখে–নিজের কথা ছাড়া যেন দুনিয়ায় আর কারও কথা ভাবে না। বাবা বেচারি সামলাতে পারছে না ছোঁড়াটাকে। তিতিবিরক্ত হয়ে বলছে, এডওয়ার্ড, দোকান তো দেখছি বন্ধ।
সে কী, দরজা তো খোলাই রয়েছে, বলেছিলাম আমি।
না, বন্ধ রয়েছে, নির্বিকারভাবে বলেছিল দোকানদার।
কর্ণপাত না করে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিলাম দরজা খুলে দিতে। কিন্তু পারিনি। দরজা সত্যিই বন্ধ রয়েছে। খোলে কার সাধ্যি। নাছোড়বান্দা ছিচকাঁদুনে ছোঁড়াটাকে টানতে টানতে বিব্রত বাবা সরে যেতেই কাউন্টারে এসে বলেছিলাম, আশ্চর্য তো! দরজা বন্ধ হয়ে গেল কীভাবে?
ম্যাজিকের জোরে! বলেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নেড়ে ব্যাপারটাকে যেন উড়িয়ে দিয়েছিল জাদুকর দোকানদার। সঙ্গে সঙ্গে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল আমার! কেননা, আঙুলের ডগা থেকে নিঃশব্দে ছিটকে গিয়েছিল অনেকগুলো রংবেরঙের তারা। ঠিক যেন রংমশাল! তারাবাজির খেলা! ঝলমলে তারাগুলো ভাসতে ভাসতে মিলিয়ে গিয়েছিল কোণের অন্ধকারে।
আমি তো হতভম্ব। কিন্তু দোকানদারের ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে। জিপের দিকে তাকিয়ে বলেছিল আপন-করে-নেওয়া সুরে–খোকা, দোকানে ঢোকবার আগে বাইরে দাঁড়িয়ে বলছিলে-না, বন্ধুবান্ধবদের তাক লাগিয়ে দেওয়ার ম্যাজিক কিনবে বড় হয়ে?
বলছিলামই তো।
পকেটেই পেয়ে যাবে।
বলেই, কাউন্টারের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে জিপের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ম্যাজিশিয়ানদের মামুলি কায়দায় ম্যাজিক বাক্স বার করে এনেছিল অদ্ভুত মানুষটা। তখনই লক্ষ করেছিলাম আশ্চর্য রকমের ঢেঙা তার আকৃতি। মানুষ যে এমন গাছের মতো লম্বা হতে পারে, জানা ছিল না। কাউন্টারের ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকার সময়েও বুঝতে পারিনি। পুরো কাউন্টারের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়েছিল হিলহিলে লম্বা দেহটা!
চক্ষুস্থির হতে তখনও বাকি আমার। ম্যাজিক বাক্স টেনে বার করেই শূন্যকে লক্ষ্য করে হাঁক দিয়েছিল সৃষ্টিছাড়া দোকানদার, কাগজ। বলেই, স্প্রিং বার-করা টুপিটার ভেতর থেকে টেনে বার করেছিল একটা প্যাকিং কাগজ। দড়ি, বলতেই, দেখি, দড়ির বাক্স হয়ে গিয়েছে দোকানদারের মুখবিবর। টানছে তো টানছেই–দড়ি যেন আর ফুরাচ্ছে না। বাক্স বাঁধা হয়ে যেতেই দাঁত দিয়ে দড়ি কেটে দিলে এবং বেশ মনে হল যেন কোঁত করে গিলেই ফেলল দড়ির বাক্স। তারপরেই একটা মোমবাতি ধরল একটা হরবোলা ডামি পুতুলের নাকের ডগায়। পিলে চমকে উঠেছিল দপ করে মোমবাতির শিখা ধরে ওঠায়। তারপরেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল যখন দেখলাম, নিজের একটা আঙুল নির্বিকারভাবে মোমবাতির শিখায় পোড়াচ্ছে দোকানদার! সর্বনাশ! এ তো আঙুল নয়–গালা! লাল গালা! গালা গলে গিয়ে টপটপ করে পড়ছে দড়ির গিঁটের ওপর। প্যাকেট সিল করে দিয়েই জিপকে বলেছিল আজব দোকানদার, এবার তো চাই অদৃশ্য-হওয়া ডিম, তা-ই না? কথাটা বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে খপ করে আমার বুকপকেট থেকে একটা ডিম বার করে প্যাক করে ফেলেছিল কাগজে। এরপরেই আবির্ভূত হল কাঁদুনে বাচ্চা–সেটাও বেরল আমারই কোটের ভেতরের পকেট থেকে। প্রতিটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছিলাম জিপের হাতে। একটা কথাও না বলে প্যাকেটগুলো আঁকড়ে ধরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটা আমার মতো এমনভাবে আকাশ থেকে পড়ার ভাব দেখায়নি আঁতকে ওঠার মতো অত ম্যাজিক দেখেও। চোখ দুটোতেই অবশ্য ফুটে উঠেছিল মনের কথা–ম্যাজিক! ম্যাজিক! এই হল গিয়ে খাঁটি ম্যাজিক!
আচমকা ভীষণ চমকে উঠেছিলাম। নরম নরম কী যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে মাথার ওপর টুপির মধ্যে? টুকুস টুকুস করে লাফ দিচ্ছে তো দিচ্ছেই?
ধাঁ করে টুপি খুলতেই ফরফর করে উড়ে নেমে এসেছিল একটা পায়রা-খড়মড় করে ঢুকে গিয়েছিল কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি বাঘটার পাশে রাখা কার্ডবোর্ড বাক্সের মধ্যে। ছি ছি ছি! বলতে বলতে মহা আড়ম্বরে টুপিখানা নিজের হাতে নিয়েছিল দোকানদার, কাণ্ডজ্ঞান দেখেছেন? ডিম পাড়বার আর জায়গা পেল না!
আরে সর্বনাশ! টুপি ঝাড়তেই যে খান তিনেক ডিম বেরিয়ে এল দোকানদারের হাতের চেটোয়। তার পরেও বেরল একটা মার্বেল গুলি, একটা ঘড়ি, আধ ডজন সেই কাচের বল আর দোমড়ানো কাগজের ডেলা। শেষোক্ত বস্তুটার যেন শেষ নেই। বেরচ্ছে তো বেরচ্ছেই। পর্বতপ্রমাণ কাগজের স্তূপের আড়ালে শেষ পর্যন্ত দোকানদারকে আর দেখতেও পেলাম না। বকবকানিই কেবল শুনে গেলাম। কী আশ্চর্য! টুপির মধ্যে এত জিনিস! তাহলেই দেখুন, ইচ্ছে করলে কত কী-ই না লুকিয়ে রাখা যায় জামা-প্যান্ট-টুপির মধ্যে… আরে… আরে… শেষ কি নেই!