আধ পেনিটা দেখেছ? ফুস করে মিলিয়ে যায় বাতাসে।
জিপ হয়েছে ওর মায়ের মতোই। শিক্ষাদীক্ষাই আলাদা। দোকানে ঢোকার নামও করেনি। আমাকে জ্বালিয়েও মারেনি। নিজের অজান্তেই কেবল আমার আঙুলটাকে টানতে টানতে নিয়ে গেছে ভেতরে ঢোকবার দরজার সামনে। ইচ্ছেটা স্পষ্ট করে তুলেই শান্ত হয়েছে। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে একটা ম্যাজিক বোতলের দিকে। বড় হলে, অনেক টাকার মালিক হলে নাকি ওটাও কিনবে।
আমি তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখুনি যদি কিনে ফেলিস, তাহলে কী করবি?
উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল জিপের চোখ-মুখ, জেসিকে দেখাব।
দরজার হাতলে হাত রেখে আমি তখন বলেছিলাম, তোর জন্মদিনের তো এখনও একশো দিনেরও বেশি দেরি রে।
জবাব দেয়নি জিপ। আমার আঙুলের ওপর মুঠোর চাপটা কেবল বেড়েছিল। তাই ঢুকতেই হয়েছিল দোকানে।
দোকানটা মামুলি দোকান নয় মোটেই। ম্যাজিকের দোকান বলেই জিপ যেসব খেলা দেখলে আনন্দে নেচে উঠত, সেসব খেলা একটাও নেই। তা সত্ত্বেও বোবা মেরে গিয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল আজব বস্তুগুলোর দিকে।
দোকানে আলোর বাড়াবাড়ি তেমন নেই পর্যাপ্ত আলোও নেই। ছোট্ট সংকীর্ণ ঘর। দরজা বন্ধ করে দিতেই দরজার ঘণ্টায় পিং পিং আওয়াজটা একনাগাড়ে বেজেই চলল পেছনে। কেউ নেই আশপাশে। বাপ-বেটায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম কিম্ভুতকিমাকার জিনিসগুলো। কাউন্টারের তলার দিকে দেখলাম একটা কাঠের মণ্ড দিয়ে তৈরি গম্ভীরবদন শান্তচক্ষু বাঘ, নিয়মিত ছন্দে নেড়ে চলেছে বিরাট মাথা। দেখলাম বেশ কয়েকটা ক্রিস্টাল বর্তুল, ম্যাজিক তাস ধরে থাকা একটা চৈনিক হাত, বিভিন্ন আকার এবং আয়তনের বেশ কিছু ম্যাজিক মাছের স্ফটিক পাত্র, একটা কদাকার ম্যাজিক টুপি, ভেতরকার স্প্রিং পর্যন্ত চোখে পড়ছে। মেঝের ওপর গড়াগড়ি যাচ্ছে ম্যাজিক আয়না, বেশ কয়েকটা। কোনওটায় প্রতিফলিত চেহারা লম্বা আর রোগাটে হয়, কোনওটায় হয় বেঁটে আর মোটা। দেখছি আর হাসছি দুজনে, এমন সময়ে দোকানে ঢুকল নিশ্চয় দোকানদার নিজেই।
ঢুকল, মানে কাউন্টারের পেছন থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু এমন আচমকা এসে দাঁড়াল সামনে যে মনে হল, ছোট্ট ওই দোকানঘরে এতক্ষণ তার কোনও অস্তিত্বই ছিল না। থাকলে দোকানে ঢুকেই কি তাকে দেখতে পেতাম না? ওইটুকু তো ঘর রে বাপু।
লোকটার চেহারা মনে রাখবার মতো। বিচিত্র বলতে যা বোঝায়, তা-ই। নোংরা। গায়ের রং কালচে। একটা কান আরেকটা কানের চেয়ে বেশি লম্বা। থুতনি তো নয়, যেন বুটজুতোর ডগা, মোটা চামড়ার টুপি পরানো।
কাউন্টারের ওপরকার কাচের বাক্সে লম্বা লম্বা দশখানা আঙুল মেলে ধরে, বললে সে আচমকা, বলুন কী দেখাব? ওই গলা শুনেই তো বুঝলাম, দোকানদার রয়েছে দোকানেই, কিন্তু এতক্ষণ তাকে দেখা যায়নি মোটেই।
খানকয়েক সোজা ধরনের ম্যাজিকের জিনিস চাই ছেলেটার জন্যে, বলেছিলাম আমি।
হাতসাফাইয়ের ম্যাজিক, না কলের ম্যাজিক? ঘরোয়া ম্যাজিক, না—
মজা পাওয়ার মতো যা হয় কিছু হলেই চলবে।
হু-উ-উম! বলে তো খচমচ করে মাথা চুলকে নিলে দোকানদার, যেন কত ভাবনাতেই না পড়েছে। তারপরেই চোখের সামনেই আস্তে আস্তে মাথার মধ্যে থেকে টেনে বার করল কিনা একটা কাচের বল! নাকের ডগার সামনে বাড়িয়ে ধরে বললে ভিজে ভিজে গলায়, এইরকম মজার জিনিস হলে চলবে কি?
তৈরি ছিলাম না এ ধরনের ম্যাজিকের জন্যে–যদিও হাতসাফাইয়ের এ ম্যাজিক আমি যে কতবার দেখেছি এর আগে, তার ঠিক নেই। সব ম্যাজিশিয়ানই রপ্ত করে এই ধরনের হস্তকৌশল, কিন্তু এ দোকানে কায়দাটা দেখবার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই। অট্টহেসে তাই বলেছিলাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই ধরনের হলেই চলবে।
যন্ত্রচালিতের মতো স্ফটিক বর্তুলকে হস্তগত করার মানসে হাত বাড়িয়েই কিন্তু বোকা বনে গিয়েছিল জিপ বেচারি। কোথায় কাচের বল? হাত তো ফাঁকা!
মুচকি হেসে বলেছিল কিম্ভুত দোকানদার, পকেটে দেখ খোকা, পেয়ে যাবে।
সত্যিই তো! জিপের পকেট থেকে বেরল আশ্চর্য বলটা!
দাম কত? জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।
বিনয়ের অবতার হয়ে তখুনি বলেছিল দোকানদার, আরে ছি ছি! কাচের বলের দাম আমরা নিই না, ওটা ফ্রি! পাচ্ছিও তো ফ্রি! বলতে বলতে আর-একখানা কাচের বল বার করেছিল নিজের কনুই থেকে। পরক্ষণেই তৃতীয় বলটাকে টেনে আনল কাঁধ থেকে। পাশাপাশি তিনটে বল সাজিয়ে রাখল কাচের কাউন্টারে। সীমাহীন শ্রদ্ধায় বলগুলোর দিকে জিপ তাকিয়ে আছে দেখে একগাল হেসে বলেছিল দোকানদার, নিয়ে যাও খোকা, এটাই বা বাদ যায় কেন? বলতে বলতে চতুর্থ বলটা টেনে বার করেছিল নিজের বদন গহ্বর থেকে।
চকিতে আমার সঙ্গে শলাপরামর্শ করে নিলে জিপ চোখে চোখে, মুখে একটি কথাও না বলে। তারপর নিবিড় নৈঃশব্দ্যকে তিলমাত্র ব্যাহত না করে বল চারখানা সরিয়ে রাখল একপাশে, ফের শক্ত করে চেপে ধরল আমার আঙুল এবং উদগ্রীব হয়ে রইল পরবর্তী ম্যাজিক দেখার জন্যে।
নৈঃশব্দ্য ভাঙল দোকানদার নিজেই। বললে, ছোটখাটো কায়দা-টায়দাগুলো দেখাই এইভাবেই।
হাসলাম। যেন ঠাট্টা শুনে মজা পেয়েছি, এইরকম একখানা ভাব করলাম।
বললাম, পাইকারি দোকানের চাইতে সস্তাও বটে।
একরকম তা-ই বটে। শেষমেশ দাম কিন্তু দিতেই হয়। তবে আগুন-দাম নয়, অনেকের যা ধারণা… বড়সড়ো ম্যাজিক, রোজকার খাবারদাবার আর অন্যান্য যা কিছু দরকার, সবই পাই ওই টুপির ভেতর থেকে… খাঁটি ম্যাজিকের দোকান বলতে যা বোঝায়, সেরকম দোকান অবশ্য কোথাও পাবেন না, পাইকারি দোকান তো নেই-ই… ঢাকবার সময়ে খেয়াল করেননি বোধহয় সাইনবোর্ডে লেখা আছে, খাঁটি ম্যাজিকের জিনিস পাবেন এখানে। বলতে বলতে একটা বিজনেস কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে দিল দোকানদার, এক্কেবারে খাঁটি জিনিস, স্যার, লোক ঠকানোর কারবার এখানে হয় না।