ধপ করে বসে পড়ল অ্যানার্কিস্ট। মুখ চুন করে চেয়ে রইল হাতে ধরা ভাঙা টিউবটার দিকে! জীবাণু যখন গাড়ির মেঝেতে কিলবিল করছে, তখন মৃত্যুও ছড়িয়ে পড়বে অচিরেই। কিন্তু নাটকটা আর হল না।
ভাঙা টিউবে টলটল করছে একটা ফোঁটা। মৃত্যুদূত নিশ্চয়ই থুকথুক করছে তার মধ্যে। খেয়ে নেওয়া যাক–শহিদ হয়ে প্রশস্ত করে যাক মৃত্যুবাহিনীর বিজয়পথকে।
কলেরার জীবাণু এখন অ্যানার্কিস্টের পেটে। ভীষণ শক্তিশালী জীবাণু তো। মাথার মধ্যে কীরকম যেন করছে। কিন্তু খামকা আর আহাম্মক বৈজ্ঞানিকটাকে উদ্বেগের মধ্যে রাখা কেন? কাজ তো হাসিল!
ওয়েলিংটন স্ট্রিটে গাড়ি ছেড়ে দিল অ্যানার্কিস্ট। দুহাত বুকের ওপর ভাঁজ করে রেখে মৃত্যু-মহিমায় উন্নতশিরে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল জীবাণু-বিজ্ঞানীর প্রতীক্ষায়।
এসে গেছে আহাম্মকটা! উন্মত্ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে অ্যানার্কিস্ট।
বেঁচে থাক অ্যানার্কিস্ট! হে বন্ধু, বড় দেরি করে ফেললে। জিনিসটা এখন আমার পেটের মধ্যে। মুক্তি পেয়েছে কলেরা খাঁচার মধ্যে থেকে।
জীবাণু-বিজ্ঞানী বুদ্ধি করে মাঝপথে একটা ছ্যাকড়া গাড়িতে উঠে পড়েছিলেন বলেই নাগাল ধরতে পেরেছিলেন বিকৃতমস্তিষ্ক অ্যানার্কিস্টের। জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে তার কথাটা শুনে সবিস্ময়ে কী যেন বলতে গেলেন, কিন্তু না শুনেই সাড়ম্বরে বিদায় অভিনন্দন। জানিয়ে হেলেদুলে ওয়াটার ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে গেল অ্যানার্কিস্ট-ভাঙা টিউবের জীবাণু পোশাকে পড়েছিল–ভেজা পোশাক ঘষটে গেল বহু পথচারীর গায়ে যত তাড়াতাড়ি রোগটা ছড়িয়ে পড়ে, ততই ভালো!
গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে হাঁ করে সেই দৃশ্য দেখছেন জীবাণু-বিজ্ঞানী, এমন সময়ে মিনি এসে দাঁড়াল তাঁর পাশে হাতে জুতো, টুপি আর ওভারকোট।
দেখে সংবিৎ ফেরে জীবাণু-বিজ্ঞানীর, ভারী বুদ্ধি তো তোমার! মনে করে ঠিক এনেছে।
বলেই আবার তন্ময় হয়ে চেয়ে রইলেন বিলীয়মান অ্যানার্কিস্টের দিকে। আচম্বিতে হেসে উঠলেন হো হো করে একটা অদ্ভুত সম্ভাবনার কথা মনে পড়ায়, বললেন হাসতে হাসতেই, মিনি, লোকটা নাম ভাঁড়িয়ে এসেছিল কলেরার জীবাণু চুরি করবে বলে–অ্যানার্কিস্ট তো লন্ডনের জলে কলেরার জীবাণু ছেড়ে দেওয়ার মতলব, কিন্তু ভুল করে কী নিয়ে গেছে জান? প্রথম ভুলটা অবশ্য আমারই। এশিয়াটিক কলেরার জীবাণু ভরতি টিউবের বদলে দেখিয়েছিলাম সেই টিউবটা–যে টিউবের জীবাণু খেয়ে ছোপ ছোপ নীল দাগে ভরে উঠেছিল বাঁদরগুলো, তিন তিনটে ছানা সমেত বেড়াল-মা বিলকুল নীল হয়ে গিয়েছিল। ঘন নীলবর্ণ ধারণ করেছিল চড়ুই পাখিটা। সেই জীবাণুই ও খেয়েছে। –জানি না কী হবে এখন–কিন্তু ওভারকোট পরতে যাব কেন? গরমে হাঁসফাঁস করছি দেখছ না? ঠিক আছে, ঠিক আছে, দাও!
জাদু বিপণি
জাদু বিপণি ( The Magic Shop)
[‘The Magic Shop’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Stand Magazine’ পত্রিকায় জুন ১৯০৩ সালে। পরে ‘Macmillan and Co.’ থেকে ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘Twelve Stories and a Dream’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়।]
দূর থেকে বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম ম্যাজিকের দোকানটা। সামনে দিয়েও গেছি কয়েকবার। দেখেছি কাচের শোকেসে লোভনীয় জাদুসামগ্রী। ম্যাজিক বল, ম্যাজিক মুরগি, বিচিত্র শঙ্কু, হরবোলা পুতুল, ম্যাজিক ঝুড়ি, ম্যাজিক তাস। দেখেই গিয়েছি এই ধরনের হরেক রকমের জিনিস–ঢোকার ইচ্ছে হয়নি কখনও। কিন্তু না ঢুকে পারলাম না সেইদিন –যেদিন আমার আঙুল ধরে হাঁটতে হাঁটতে জিপ টেনে নিয়ে গেল দোকানটার সামনে, একটার পর একটা জিনিস দেখাতে দেখাতে বুঝিয়ে দিলে, উপায় নেই, ঢুকতেই হবে ভেতরে। সত্যি কথা বলতে কী, দোকানটা যে রিজেন্ট স্ট্রিটেই আছে, তা-ও তো মাথায় আসেনি কখনও, রয়েছে মুরগির ছানা আর ছবির দোকানের ঠিক মাঝখানে। আমার কিন্তু বরাবরই মনে হয়েছে, এ দোকান যেন দেখেছি সার্কাসে, অথবা অক্সফোর্ড স্ট্রিটের মোড়ে, অথবা হলবর্নে। রাস্তার ওপরেই, কিন্তু ভেতরে ঢোকার পথটা কখনও পাওয়া যায়নি। মরীচিৎকার মতো দোকানের অবস্থান যেন ধাঁধা সৃষ্টি করে গেছে এতটা কাল। কিন্তু কী আশ্চর্য! ওই তো সেই দোকান! জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনেই, বিস্তর জাদুসামগ্রী যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে, ভেতরে এসো! ভেতরে এসো! আঙুল তুলে একটার পর একটা জিনিস দেখতে দেখতে শেষকালে কাচের ওপর আঙুলের বাজনা পর্যন্ত শুনিয়ে দিলে জিপ।
ঠকঠক করে কাঁচে আঙুল ঠুকে একটা আজব ডিম দেখিয়েছিল, অদ্ভুত ক্ষমতা এই ডিমের, অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে যখন-তখন। বলেছিল, জান বাবা, বড়লোক যদি হতাম, তাহলে আমিই কিনে ফেলতাম। আর ওই যে ওইটা দেখছ– ঠকঠক ঠকঠক শব্দে আঙুল ঠুকে এবার দেখিয়েছিল একটা কাঁদিয়ে শিশুকে, দেখতে অবিকল মানুষের শিশুর মতোই, পুতুল বলে মনেই হয় না, ওটাও কিনতাম। রহস্যময় এইসব ম্যাজিকের জিনিসপত্রের পাশে রাখা কার্ডটার দিকেও শেষ পর্যন্ত আঙুল তুলে দেখিয়েছিল জিপ। কার্ডে লেখা যে। কোনও একটা জিনিস কিনে নিয়ে গিয়ে বন্ধুদের মুন্ডুগুলো ঘুরিয়ে দাও।
জিপের মুখে তখন খই ফুটছে, ওই যে শব্দুগুলো দেখছ-না বাবা, ওর নিচে জিনিস রাখলেই অদৃশ্য হয়ে যায়। বইতে পড়েছি। তারপরেই