এই তো… দেখা যাচ্ছে। আহামরি অবশ্য কিছু নয়। গোলাপি রঙের পুঁচকে কতকগুলো ডোরা আর ফালি। অথচ দেখুন, এই খুদে পরমাণু থোকারাই গোটা শহরকে তছনছ করে দিতে পারে। ওয়ান্ডারফুল!
বলে, কাচের স্লাইডটা নিয়ে মাইক্রোস্কোপের ধার থেকে সরে গেল জানলার পাশে। আলোর সামনে স্লাইড তুলে ধরে বললে, দেখাই যাচ্ছে না। বেঁচে আছে তো? এখনও কি বিপজ্জনক?
রং দিয়ে রাঙিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। যদি পারতাম, বিশ্বের সমস্ত কটা জীবাণুকে এইভাবে মারতাম।
ক্ষীণ হাসি ভেসে ওঠে বিবর্ণমুখ লোকটার ঠোঁটে–জীবন্ত জীবাণু, আপনার ঘরে রাখতে চান না–এই তো?
মোটেই তা নয়। জীবন্ত জীবাণুই তো রাখতে হয়। যেমন ধরুন এই জীবন্ত জীবাণুগুলো, বলতে বলতে ঘরের আরেকদিকে গিয়ে মুখ-আঁটা একটা টিউব তুলে নিলেন জীবাণু-বিজ্ঞানী–রোগজীবাণুর চাষ করে পাওয়া এই দেখুন বেশ কিছু সজীব জীবাণু। বোতল-কলেরাও বলতে পারেন।
ক্ষণেকের জন্যে যেন পরম খুশির হালকা হাসি ভেসে যায় সাক্ষাৎপ্রার্থীর পাতলা ঠোঁটের ওপর দিয়ে। দুচোখ দিয়ে যেন গিলতে থাকে ছোট্ট টিউবটা।
নজর এড়ায় না জীবাণু-বিজ্ঞানীর। লোকটার চোখে-মুখে অস্বাস্থ্যকর রুগ্ণ আনন্দের দ্যুতি। প্রথম থেকেই খটকা লেগেছিল জীবাণু-বিজ্ঞানীর। হাবভাব কীরকম যেন খাপছাড়া। অথচ পরিচয়পত্র নিয়ে এসেছে এক বন্ধুর কাছ থেকে। বিজ্ঞানসাধকরা হয় শান্তশিষ্ট, আত্মচিন্তায় সদানিমগ্ন। কালোচুলো এই লোকটার গভীর ধূসর চোখে কিন্তু উদ্ভ্রান্ত চাহনি, হাবভাব ছটফটে-নার্ভাস। চঞ্চল কিন্তু তীক্ষ্ণ চাহনি নিবদ্ধ কাচের টিউবের ওপর, ঠিক এই ধরনের বিজ্ঞানসাধকের সংস্পর্শে কোনওদিন আসেননি জীবাণু-বিজ্ঞানী। হয়তো তাঁর আবিষ্কার লোকটাকে চঞ্চল করে তুলেছে, এমনটা হওয়াও বিচিত্র নয়।
টিউব হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন জীবাণু-বিজ্ঞানী চিন্তাকুটিল ললাটে। বললেন নিবিষ্ট স্বরে, মহামারীকে বন্দি করে রেখেছি এই টিউবের মধ্যে। খাবার জলের চালান যাচ্ছে যেখান থেকে, ছোট্ট এই টিউবটাকে যদি ভেঙে ফেলেন সেই জলের মধ্যে, তাহলেই দেখবেন এই খুদে অণুবীক্ষণে দৃশ্যমান প্রাণীগুলোর ক্ষমতা। অথচ এদের গায়ে গন্ধ নেই, খেতেও বিস্বাদ নয়–অত্যন্ত শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ না হলে দেখাও যায় না। কিন্তু তুচ্ছ প্রায়-অদৃশ্য এই এদেরকে জলে ঢেলে দিয়ে যদি হুকুম দেন–যাও হে মৃত্যুদূতেরা, বংশবৃদ্ধি করে ছেয়ে ফেল সব কটা সিসটার্ন আর চৌবাচ্চা–তাহলেই ভয়ানক মৃত্যু আসবে চক্ষের নিমেষে, রহস্যময় সেই মৃত্যুর কিনারা করাও যাবে না, যন্ত্রণাময় মৃত্যু অসীম লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে এক-একটা মানুষকে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেবে মৃত্যুকূপে। সারা শহর জুড়ে তাথই তাথই নাচ নেচে চলবে মৃত্যু-যজ্ঞের সৈনিকরা–এই প্রায়-অদৃশ্য জীবাণুরা। নিজেরাই শিকার খুঁজে বার করবে–কাউকে দেখিয়েও দিতে হবে না। স্বামীকে ছিনিয়ে নেবে স্ত্রীর কাছ থেকে, শিশুকে মায়ের কোল থেকে, রাজনীতিবিদকে কঠিন কর্তব্যের মধ্যে থেকে। শ্রমিককে আর উদয়াস্ত হাড়ভাঙা মেহনত নিয়ে কষ্ট পেতে হবে না। এগিয়ে যাবে জলের মেইন পাইপ দিয়ে, গুটিশুটি এগবে রাস্তা বরাবর, যেসব বাড়িতে জল ফুটিয়ে খাওয়ার হাঙ্গামা কেউ পোয়াতে চায় না–ঠিক সেইসব বাড়িতেই হানা দিয়ে সাজা দেবে মৃত্যুর পরোয়ানা হাজির করে, খনিজ জল উৎপাদন করে যারা–সেঁধিয়ে বসবে তাদের কুয়োর জলে, মিশে যাবে স্যালাডে, ঘুমিয়ে থাকবে বরফের মধ্যে। ঘোড়াদের জল খাবার চৌবাচ্চায় ওত পেতে থাকবে আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিবারণের সুযোগ নিয়ে উদরে প্রবেশের অপেক্ষায়, রাস্তার কল থেকে স্কুলের ছেলেমেয়েরা যখন নিশ্চিন্ত মনে জল খাবে–তখন তাদেরও একে একে টেনে নিয়ে যাবে মৃত্যুর অজানা লোকে। মাটি শুষে নেবে মহাভয়ংকর এই সৈনিকদের, কিন্তু আবার বেরিয়ে আসবে হাজার হাজার অপ্রত্যাশিত পথে-ঝরনার জলে, কুয়োর জলে। জলাধারে একবার ছেড়ে দিলেই হল–ডেকে ফিরিয়ে এনে ফের বন্দি করার সুযোগ বা সময়ও আর দেবে না–মহাশ্মশান করে ছাড়বে বিশাল এই শহরকে।
অকস্মাৎ স্তব্ধ হলেন জীবাণু-বিজ্ঞানী। বাগ্মিতা তাঁর এক দুর্বলতা। সবাই বলে, নিজেও জানেন।
শেষ করলেন ছোট্ট কথায়, এই টিউবের মধ্যে মহামারীর মৃত্যুদূতরা কিন্তু সুরক্ষিত।
ঘাড় নেড়ে নীরবে সায় দেয় বিবর্ণমুখ লোকটা। কিন্তু চকচক করছে দুই চোখ। কেশে গলা সাফ করে নিয়ে বললে, তাহলেই দেখুন, অরাজকতা সৃষ্টি করার জন্যে যারা আদা জল খেয়ে লেগেছে, সেই অ্যানার্কিস্টগুলোর মতো মহামূর্খ আর নেই। বোমা-টোমার দরকার কী? হাতের কাছেই রয়েছে যখন এমন নিঃশব্দ, মোক্ষম অস্ত্র। আমার তো মনে হয়–
মৃদু টোকা শোনা গেল দরজায়। নখ দিয়ে কে যেন টোকা মারছে।
দরজা খুলে দিলেন জীবাণু-বিজ্ঞানী।
সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর স্ত্রী। বললেন, একটা কথা আছে, বাইরে আসবে?
স্ত্রীর সঙ্গে কথা শেষ করে ল্যাবরেটরিতে ফিরে এসে জীবাণু-বিজ্ঞানী দেখলেন, ঘড়ি দেখছে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী।
বললে, চারটে বাজতে বারো মিনিট। ঘণ্টাখানেক সময় নষ্ট করলাম আপনার। যাওয়া উচিত ছিল সাড়ে তিনটেয়। কিন্তু এমন কৌতূহল জাগিয়ে ছেড়েছিলেন যে খেয়ালই ছিল না। এখন চলি–ঠিক চারটেয় একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।