আর-একটা চলমান বস্তু দেখেছিল মি. কেভ। হনহন করে আসছিল রাস্তা বেয়ে। কাছাকাছি আসতেই দেখা গিয়েছিল ধাতুর জটিল চকচকে কলকবজা। পরক্ষণেই দৃষ্টিপথ থেকে উধাও হয়েছিল চলমান রহস্য।
মঙ্গলগ্রহীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার অনেক চেষ্টা করেছে মি. কেভ। পৃথিবীর দৃশ্য নিয়ে যেন সন্তুষ্ট নয়, অথবা যেন যা দেখা যাচ্ছে তা মনের মতো নয়–এরকম ভাব দেখা দিয়েছে বিশাল চোখে। তাই একদিন গ্যাঁট হয়ে বসে ছিল মি. কেভ নজর কাড়ার জন্যে বিশাল চোখ দুটো এক্কেবারে সামনাসামনি দেখেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আলো-টালো জ্বেলে নানারকম ইশারা ইঙ্গিত করেছিল। কিন্তু পলকের মধ্যেই সরে গিয়েছিল মঙ্গলগ্রহী– অন্য খুঁটির ডগায় চোখ রেখেছিল। মি. কেভের অস্তিত্ব যেন টেরই পায়নি।
নভেম্বর মাসটা গেল এইভাবে। ডিসেম্বরের গোড়ায় পরীক্ষার চাপে মি. ওয়েস সময় দিতে পারেনি দিন সাতেকের মতো। এই ফাঁকে ক্রিস্টাল সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরত মি. কেভ–বাড়ির হাঙ্গামা ততদিনে ঝিমিয়ে এসেছিল। দিন দশ-এগারো পরে ক্রিস্টালের জন্যে মনটা হু হু করে ওঠায় মি. ওয়েস নিজেই দৌড়েছিল মি. কেভের বাড়ি।
গিয়ে দেখলে, বন্ধ হয়ে গেছে দোকান। কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এল মিসেস কেভ। পরনে কালো পোশাক।
মি. কেভ? এখন পরলোকে। এইমাত্র কবরখানা থেকেই ফিরছে মিসেস কেভ।
মি. ওয়েসের কাছ থেকে ক্রিস্টাল নিয়ে আসবার পরের দিন খুব ভোরবেলায় মরে কাঠ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় মি. কেভকে। শক্ত, আড়ষ্ট আঙুলের ফাঁকে ধরা ছিল ক্রিস্টাল ডিমটা–পায়ের কাছে লুটাচ্ছিল কালো ভেলভেটটা–যা দিয়ে মাথা-মুখ চাপা দিত মি. কেভ। ক্রিস্টালের ভেতর দিয়ে অন্য জগতের দৃশ্য দেখার সময়ে।
মরে কাঠ হয়ে গেলেও মি. কেভের মুখে নাকি তৃপ্তির হাসি লেগে ছিল। যেন অনেক সুখ, শান্তি নিয়ে এসেছে মরণ।
শরীর তার খারাপ যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন–চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল মি. ওয়েসের। না করার ফলেই তো এই কাণ্ড। মনটা তাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল ভদ্রলোকের। তা সত্ত্বেও খোঁজ নিয়েছিল ক্রিস্টাল সম্বন্ধে। আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল মিসেস কেভের জবাব শুনে।
বেচে দেওয়া হয়েছে ক্রিস্টাল ডিম। মালিকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিধবা বউ ডিমটা নিয়ে ওপরতলায় গিয়ে খুঁজেছিল পাদরির ঠিকানা। ঠিকানা আর পাওয়া যায়নি। কড়কড়ে পাঁচ পাউন্ড এভাবে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় পাগলের মতো ছুটেছিল আরেক দোকানদারের কাছে–দোকানের হাবিজাবি জিনিস বেচে সেই টাকায় ধুমধাম করে মালিককে গোর দিতে হবে। ধুরন্ধর সেই দোকানদার জলের দামে ক্রিস্টাল ডিম সমেত অনেক জিনিসই কিনে নিয়ে গেছে।
মি. ওয়েস তৎক্ষণাৎ দৌড়েছিল তার কাছে। দুঃসংবাদ শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল। ডিমটা এই তো সেদিন বিক্রি হয়ে গেল। লম্বামতো একটা লোক কিনে নিয়ে গেছে–জামা-প্যান্ট ধূসর রঙের। কোনদিকে গেছে, কোথায় থাকে–তা তো জানা নেই। দোকানদারের।
কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও লাভ হয়নি। কেউ সাড়া দেয়নি। যে কিনেছে, সে নিশ্চয় কিউরিয়ো-সংগ্রাহক নয়। হলে বিজ্ঞাপন পড়ে সাড়া দিত। খেয়ালের বশে কিনে নিয়ে গিয়ে এই লন্ডন শহরেই হয়তো কাগজ-চাপা করে টেবিলে রেখে দিয়েছে। ক্রিস্টালের মহিমা এখনও জানে না।
মি. ওয়েসের কাছে লেখা বিবরণগুলো ছিল। বিষয়টি দুটো পত্রিকায় প্রকাশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু দুটো পত্রিকাই এসব গালগল্পে কান দেয়নি।
তাই কাগজপত্র এল আমার হাতে। এ কাহিনি আমি লিখলাম গল্পের আকারে। মনে মনে। কিন্তু মি. ওয়েসের সঙ্গে একমত। আশ্চর্য সেই জগৎ মঙ্গল গ্রহ নিঃসন্দেহে। মঙ্গলগ্রহীরাই ক্রিস্টালটাকে পাঠিয়েছে পৃথিবীতে–ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর দৃশ্য দেখবার জন্যে। হয়তো তাদের কেউ কেউ এসেছে এই গ্রহে। এটা ঘটনা, কল্পনা নয়, মরীচিকা নয়।
দীর্ঘদেহী ধূসরবেশী লোকটা কে, তা আজও জানা যায়নি। তবে পাদরি আর তার সঙ্গী তরুণের হদিশ পাওয়া গেছে। পাদরির নাম রেভারেন্ড জেমস পার্কার। সঙ্গী তরুণটি জাভার বোসেন-কুনির যুবরাজ। মি. কেভ ক্রিস্টাল বেচতে অনিচ্ছুক দেখেই চড়া দামে বস্তুটি দখলে আনতে চেয়েছিল–আর কোনও উদ্দেশে নয়।
ক্রিস্টাল যেখানেই থাকুক–তার সঙ্গে কিন্তু যোগাযোগ রয়েছে মঙ্গল গ্রহের জুড়ি ক্রিস্টালের–এটাও একটা ঘটনা, অলীক কল্পনা নয়!
চোরাই জীবাণু
চোরাই জীবাণু (The Stolen Bacillus)
[‘The Stolen Bacillus’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৪ সালের জুন মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায়। ১৮৯৫ সালে লন্ডনের ‘Methuen & Co.’ থেকে প্রকাশিত ওয়েলসের প্রথম ছোট গল্পের সংকলন ‘The Stolen Bacillus and Other Incidents’-তে গল্পটি স্থান পায়। প্রথম বায়ো-টেররিজমের উল্লেখ এই গল্পেই পাওয়া যায়।]
মাইক্রোস্কোপের তলায় কাচের প্লেট ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন জীবাণুবিজ্ঞানী, এই হল গিয়ে স্বনামধম্য কলেরা-ব্যাসিলাস–কলেরার জীবাণু।
পাঙাসপানা মুখ নিয়ে অণুবীক্ষণে একটা চোখ রাখল লোকটা। মাইক্রোস্কোপ দেখতে অভ্যস্ত নয় নিশ্চয়, তাই শীর্ণ শিথিল একটা সাদা হাতে চাপা দিলে অন্য চোখটা।
বললে, কিসসু দেখতে পাচ্ছি না।
স্ক্রু-টা ঘুরিয়ে আপনার চোখের উপযোগী করে মাইক্রোস্কোপ ফোকাস করে নিন। সবার চোখে সমান দৃষ্টি তো থাকে না। এইদিকে সামান্য একটু ঘোরান।