মি. ওয়েস দেখত বৈজ্ঞানিক কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্যে–মি. কেভও আসত প্রায় রোজই-কল্পনা-রঙিন মনোজগতের খোরাক জোগানোর জন্যে। যেহেতু দেখার ব্যাপারে ভদ্রলোকের ক্ষমতা ছিল মি. ওয়েসের চাইতে বেশি, তাই গড়গড় করে বলে যেত মি. কেভ আশ্চর্য দেশের অদ্ভুত বৃত্তান্ত–অন্ধকারেও লেখার অভ্যেস থাকায় সেই বর্ণনা খুঁটিয়ে লিখে নিত মি. ওয়েস। লিখেছিল বলেই এই কাহিনি লেখবার সুযোগ এসেছে।
পাখির মতো উড়ুক্কু প্রাণীগুলো সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল মি. কেভের মনকে। প্রথমে মনে হয়েছিল এক জাতের বাদুড়। তারপর মনে হল পরি-টরি নয় তো? মাথাটা গোলাকার–অনেকটা মানুষের মাথার মতো। চওড়া রুপোলি ডানায় কিন্তু পালক নেই– পাখি, বাদুড়ের ডানার নকশায় নির্মিত নয় মোটেই। মরা মাছের মতোই চকচকে রং ঝলমলে পাখা বরাবর রয়েছে বাঁকা পাঁজরা–যেমনটা থাকে প্রজাপতির ডানায়। দেহটা ছোট। কিন্তু মুখের কাছে আছে দুগুচ্ছ শুড়, এদেরই একজনের বিশাল চোখ দেখে প্রথমদিকে অমন আঁতকে উঠেছিল মি. কেভ।
মি. ওয়েসের কেন জানি মনে হয়েছিল, আশ্চর্য দেশের বাগান, বাড়ি, খুঁটি–সবকিছুরই প্রভু কিন্তু এই উড়ুক্কু জীবেরা। বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করত তারা অদ্ভুত পন্থায়। দরজা দিয়ে নয়। দরজার বালাই ছিল না বিশাল বাড়িগুলোয়। ছিল বিস্তর গোলাকার গবাক্ষ। উড়ুক্কু প্রাণীগুলো শুড়ের ওপর ভর দিয়ে টুক করে নামত জানলার সামনে, ডানা মুড়ে পাশে গুটিয়ে আনত সরু রডের আকারে, তারপর ছোট্ট লাফ মেরে ঢুকে যেত ভেতরে। ছোট ডানাওয়ালা বিস্তর প্রাণী ঘুরত এদের সঙ্গে। অনেকটা বিশালকায় গঙ্গাফড়িঙের মতো। অথবা মথ আর উড়ুক্কু গুবরেপোকার মতো। খোলা লনে গুটিগুটি ঘুরে বেড়াত রং ঝলমলে দানবিক গুবরেপোকাসদৃশ ডানাহীন প্রাণী। পথে আর ছাদেও দেখা যেত উড়ুক্কু প্রাণীদের মতো প্রাণী–ডানা বাদে। মাথা বিরাট। শুড়ের ওপর হাতের মতো ভর দিয়ে লাফ দিয়ে ঘুরত ছাদে, রাস্তায়, লনে।
খুঁটির মাথায় চকচকে বস্তুগুলো নিয়েও মাথা ঘামিয়ে চমকপ্রদ সিদ্ধান্তে এসেছিল মি. ওয়েস। দেখেছিল, বিশটা খুঁটি অন্তর একটা করে খুঁটির মাথায় রয়েছে চকচকে বস্তুগুলো। মাঝে মাঝে ডানাওয়ালা উড়ুক্কু প্রাণীরা এসে শুড় দিয়ে খুঁটির ডগা জড়িয়ে ধরে চেয়ে থাকে চকচকে বস্তুগুলোর দিকে।
দেখেই খটকা লেগেছিল। তবে কি ক্রিস্টাল ডিমের মতোই অগুনতি ডিম বসানো রয়েছে খুঁটির মাথায়? এখানকার ডিম দিয়ে যেমন ওখানকার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, ওখানকার ডিমের মধ্যেও কি তেমনি এখানকার দৃশ্য ফুটে উঠছে? এখানকার ডিম যেখানে খুশি বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়–ওখানকার ডিম কিন্তু খুঁটির ডগায় আটকানো। এইরকম ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে অন্য জগতের এক বাসিন্দা কি দেখতে পেয়েছিল মি. কেভকে? তার বিশাল চোখ দেখেই তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম হয়েছিল মি. কেভের। তবে কি এখানকার ক্রিস্টাল একই সঙ্গে অবস্থান করছে দুটো জগতে? দুটো ক্রিস্টালের মধ্যে যোগসাজশ আছে? পৃথিবীজোড়া কাণ্ডকারখানার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাবনাটাকে একান্ত সম্ভবপর বলেই মনে হয়–অন্তত আমার কাছে।
আশ্চর্য এই জগৎটা তাহলে রয়েছে কোথায়? অচিরেই এই প্রশ্নের জবাব জুগিয়ে দিয়েছিল মি. কেভ। ভারী হুঁশিয়ার লোক। যা দেখে তা ভোলে না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল বলেই জানা গিয়েছিল আশ্চর্য সেই জগতের ঠিকানা।
চোখ পাকিয়ে একদিন ক্রিস্টালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মি. কেভ দেখলে, সূর্য ডুবে যাচ্ছে আশ্চর্য জগতে; তারা দেখা যাচ্ছে কালো আকাশে। তবে আকাশ যেন আরও কালচে। তারাগুলোও চেনা–সৌরজগতে যেসব নক্ষত্রমণ্ডলী দেখা যায়– সেইগুলোই, তবে রয়েছে আরও দূরে। অদ্ভুত এই জগৎ তাহলে রয়েছে সৌরজগতেই পৃথিবী থেকে আরও কয়েক কোটি মাইল দূরে, তাই সূর্যকে আরও ছোট দেখিয়েছে দিনের বেলা–আকাশকে মনে হয়েছে আরও ঘন নীল। এই সূর্যই সেদিন ডুব দিতেই দু-দুটো চাঁদকে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে আকাশে!
হ্যাঁ, জোড়া চাঁদ। উত্তেজিতভাবে মি, কেভ বলেছিল, আমাদের চাঁদা মামার মতোই তাদের দেখতে। তবে আয়তনে অনেক ছোট। দুটোর একটা এত জোরে ছুটছে যে, শুধু চোখেই ছোটার বেগ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ দুটো চাঁদই গ্রহের এত কাছে রয়েছে যে, দিকরেখা ছাড়িয়ে বেগে উঠে আসতে-না-আসতেই চন্দ্রগ্রহণ হয়ে যাচ্ছে!
সৌরজগতে একটি গ্রহের ক্ষেত্রেই এইসব তথ্যপঞ্জি মিলে যায়। নাম তার মঙ্গল গ্রহ!
ডানাওয়ালা জীবগুলো তাহলে মঙ্গলগ্রহী। ডানা যাদের নেই, কিন্তু বাদবাকি চেহারা একই রকম–তারা তাহলে কে? তারাও কি মঙ্গলগ্রহী? কৃত্রিম ডানা লাগিয়ে উড়ে বেড়ায় দরকারমতো?
ডানা থাকুক আর না থাকুক, এরাই যে মঙ্গল গ্রহের প্রভু, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিদঘুটে দুপেয়ে একজাতীয় জীবকে শেওলা বৃক্ষ খেতে দেখেছিল মি. কেভ। দেখতে অনেকটা নর-বানরের মতো। দেহ আংশিক স্বচ্ছ। হঠাৎ শুড় বাড়িয়ে তেড়ে এল ডানাহীন একটা মঙ্গলগ্রহী। হুটোপাটি করে পালিয়েও আংশিক স্বচ্ছ দুপেয়েরা রক্ষে পায়নি। শুড় বাড়িয়ে একজনকে সাপটে ধরেছিল গুবরেপোকার মতো মঙ্গলগ্রহী। তারপরেই ক্রিস্টাল অস্পষ্ট হয়ে আসায় আর কিছু দেখা যায়নি। কিন্তু ঘাম ছুটে গিয়েছিল মি. কেভের।