প্রথম যখন এই দৃশ্য দেখেছিল মি. কেভ, তখন তা ক্ষণেকের জন্যে ঝলসে উঠেই মিলিয়ে গিয়েছিল–অস্পষ্ট কুয়াশার আড়ালে যেন ঢেকে গিয়েছিল। বিশাল একটা তেপান্তরের মাঠের দিকে যেন চেয়ে আছে ভদ্রলোক। চেয়ে আছে ওপর থেকে নিচে। খুব উঁচু বাড়ি বা মাস্তুলের ওপর থেকে নিচের দিকে তাকালে বহু দূরের বহু দৃশ্য যেমন একসঙ্গে দৃষ্টিসীমায় জেগে ওঠে–ঠিক সেইভাবে দেখেছিল একসঙ্গে পূর্ব-পশ্চিম উত্তর দক্ষিণের দৃশ্য। পরিচিত তারা দেখে বুঝতে পেয়েছিল কোনদিকটা উত্তর, আর কোনদিকটা দক্ষিণ। পূর্ব আর পশ্চিমে বহু দূরে রয়েছে আকাশছোঁয়া লালচে খাড়া পাহাড়–কোথায় যেন এর আগেও দেখেছে এই পাহাড় মি. কেভ, চেনা চেনা মনে হয়েছে, কিন্তু মনে করতে পারেনি। উত্তর আর দক্ষিণেও ঘুরে এসেছে লালচে পাহাড়। পাহাড়বেষ্টিত ধু ধু প্রান্তরে সঞ্চরমাণ অনেক কিছুই। অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে বিশাল উঁচু বাড়ির পর বাড়ি। অদ্ভুত আকারের ঘন শেওলা-সবুজ গাছপালা। কয়েকটা গাছ উৎকৃষ্ট ধূসর। দেখা যাচ্ছে একটা চকচকে খাল। মি. কেভ রয়েছে পূর্বদিকের পাহাড়ের কাছে। পাহাড় পেরিয়ে যেন একদল পাখি উড়ে আসতে আসতে প্রতিসরিত আলোর অস্পষ্টতায় মিলিয়ে গেল। সুস্পষ্টভাবে আর দেখা গেল না। তখন সূর্য উঠছে পাহাড়ের ওপর। সূর্যের সামনে কালো ছায়ার মতো উড়ুক্কু বস্তুগুলোকে পাখি বলেই মনে হয়েছিল মি. কেভের। তারপরেই ঝলমলে রঙিন বিশাল একটা বস্তু উড়ে গেল ছবির ওপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে। প্রথমবার দেখেই হাত কেঁপে গিয়েছিল ভদ্রলোকের, মাথা সরে গিয়েছিল। দৃশ্যপট কুয়াশা-আবিল হয়ে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে অনেক সময় নিয়ে আবার তা দেখতে পেয়েছিল পরে।
মি. ওয়েসের কাছে শুনেছি, মি. কেভের এই অভিজ্ঞতায় নাকি বাড়াবাড়ি নেই মোটেই। যদিও অনেক চেষ্টা করেও মি. কেভের মতো পরিষ্কারভাবে সেই দৃশ্য দেখতে পায়নি মি. ওয়েস–তা সত্ত্বেও ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতাকে ভাবাবেগে আচ্ছন্ন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এটাও ঠিক যে, মি. কেভের কাছে যা সুস্পষ্ট দৃশ্য, মি. ওয়েসের কাছে তা ধোঁয়াটে নীহারিকার মতো দৃশ্যপট ছাড়া আর কিছুই নয়।
দৃশ্যটা আবার সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল দিন সাতেক পরে। এই সাত দিনে তেপান্তরের মাঠে ভাসা-ভাসা অনেক কিছুই চোখে পড়েছিল। কিন্তু প্রতিবারেই কেন জানি মনে হয়েছিল, একই জায়গায় থেকে অদ্ভুত এই দৃশ্যপটের দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে মি. কেভ। দৃষ্টিকোণ পালটালেই এক-একদিকের দৃশ্য ফুটে উঠছে চোখের সামনে। অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে একটা বিরাট বাড়ির অসম্ভব দীর্ঘ ছাদ। ছাদের মাঝখানে রয়েছে অনেকগুলো উঁচু খুঁটি। প্রত্যেকটা খুঁটির ডগায় সূর্যের আলোয় চকচক করছে একটা করে খুদে জিনিস। খুঁটিগুলো সমান দূরত্বে, নিয়মিত ব্যবধানে খাড়া ছাদের ঠিক মাঝখানে। চকচকে খুদে জিনিসগুলো যে আসলে কী, তা পরে বুঝেছিল মি. কেভ। বাড়ির পরেই নিবিড় গাছপালা। তারপর ঘাস-ছাওয়া মাঠের ওপর গুটিগুটি নড়ছে গুবরেপোকার মতো অনেকগুলো প্রাণী আয়তনে যদিও প্রকাণ্ড। মাঠের পরেই গোলাপি পাথর-বাঁধাই একটা রাস্তা। রাস্তার ওপারে দূরের পাহাড়ের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বিস্তৃত একটা নদী। দুপাশে ঘন লাল ঝোপ। নদীর জল চকচকে আয়নার মতো। উপত্যকার একদিক থেকে আরেকদিকে চলে গিয়েছে এই চওড়া নদীপথ। বাতাস যেন মথিত বহু পাখির ডানাসঞ্চালনে। ঘুরছে গোল হয়ে। নদীর ওপারে অসংখ্য আকাশছোঁয়া প্রাসাদ। উজ্জ্বল রঙিন এবং যেন চকচকে ধাতু দিয়ে কারুকাজ করা। আশপাশে শেওলা-সবুজ অরণ্য। আচমকা কী যেন ডানা ঝাঁপটিয়ে চলে এসেছিল চোখের সামনে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছিল মি. কেভের মুখের সামনে। যেন রত্নখচিত হাত-পাখা সঞ্চালন অথবা ডানা ঝাপটানির সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত সেই মুখের ওপরের অংশ, অর্থাৎ শুধু দুটো বিশাল চোখ চলে এসেছিল মি. কেভের চোখের একদম সামনে–এত কাছে যেন ক্রিস্টাল ডিমের ঠিক উলটোদিকে। আঁতকে উঠে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল মি. কেভ। আবার ফিকে হয়ে এসেছিল ক্রিস্টাল। অন্ধকার দোকানঘরে পরিচিত মিখাইল আর সোঁদা সোঁদা গন্ধের মধ্যে বসে ঘেমে গিয়েছিল ভদ্রলোক। নিবিষ্ট হয়ে থাকায় এতক্ষণ খেয়ালই ছিল না, বসে রয়েছে নিজের দোকানেই–অন্য জগতে নয়।
ক্রিস্টাল ডিমের ভেতরের আশ্চর্য দেশ যেন পেয়ে বসেছিল মি. কেভকে সেই থেকেই। সময় পেলেই উঁকি মেরে দেখত ক্রিস্টালের ভেতরে। যেমন নতুন খেলনা নিয়ে তন্ময় থাকে শিশু–অন্য কোনওদিকে হুঁশ থাকে না, কারও হাতে খেলনা ছাড়তে চায় না–মি. কেভের অবস্থাও হয়েছিল সেইরকম। প্রথমদিকের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাই সহজ-সরলভাবে খোলাখুলি শুনিয়েছিল মি. ওয়েসকে। আজব ক্রিস্টাল হঠাৎ আবির্ভূত খদ্দেরদের হাতে পাচার হওয়ার সম্ভাবনা ঘটতেই অস্থির হয়ে উঠেছিল। তুমুল ঝগড়া লেগেছিল বাড়িতে। অত্যাচার চলেছিল মনের ওপর।
কিন্তু মি. কেভের মতো ক্রিস্টাল দুনিয়া নিয়ে ছেলেমানুষের মতো ভুলে থাকতে পারেনি মি. ওয়েস। বৈজ্ঞানিক মন নিয়ে তদন্তকারীর মতোই পদ্ধতিমাফিক অবিশ্বাস্য এই নয়া জগৎকে খুঁটিয়ে দেখতে প্রয়াসী হয়েছিল বিজ্ঞানীদের মতোই। আলোকরেখা কখন পড়বে ক্রিস্টালে–এই ভরসায় না থেকে বৈদ্যুতিক আলো ফেলার ব্যবস্থা করেছিল ক্রিস্টাল ডিমে। মোটা ভেলভেট চাপা দেওয়ার চাইতে উন্নততর ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটিয়ে এবং ক্রিস্টালকে ঠিক কোনদিক থেকে দেখলে দৃশ্যাবলি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে, তা আবিষ্কার করার পর থেকে ক্রিস্টাল জগতের সব দৃশ্যই যখন খুশি দেখতে পেত মনের আশ মিটিয়ে।