এই কাহিনি মি. ওয়েসের মুখেই শোনা। সুতরাং মি. কেভের আশ্চর্য অভিজ্ঞতার ঘটনাগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সন্ধের দিকে মি. ওয়েসের কাছে ফের গিয়েছিল মি. কেভ। শুনিয়েছিল রহস্যনিগুঢ় এক কাহিনি। ক্রিস্টাল ডিমটা তার হাতে এসেছিল অন্যান্য পাঁচটা জিনিসের সঙ্গে এক কিউরিয়ো দোকানির কাছ থেকে–দেনার দায়ে জলের দামে বেচে দিয়েছিল সমস্ত হাবিজাবি জিনিস। ডিমটার মূল্যায়ন করা তখন সম্ভব হয়নি বলে মি. কেভ দীর্ঘদিন দশ শিলিং-এর টিকিট ঝুলিয়ে রেখেছিল ডিমের গায়ে। তারপর যখন ভাবছে, দামটা আরও কমানো যায় কি না, এমন সময়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল অদ্ভুত একটা আবিষ্কারের পর।
শরীর তখন খুবই খারাপ যাচ্ছে মি. কেভের। এই ঘটনার গোড়া থেকেই স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু হয়েছিল ভদ্রলোকের। নিজেও গা করেনি। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙেছে মনও। স্ত্রী আর সৎ ছেলেমেয়ে চূড়ান্ত দুর্ব্যবহার চালিয়ে গেছে স্বাস্থ্যভঙ্গ সত্ত্বেও, গুণের শেষ নেই বউয়ের, এক নম্বরের দাম্ভিক, স্বামীর জন্যে তিলমাত্র সহানুভূতি নেই মনে, অত্যন্ত খরুচে। লুকিয়ে-চুরিয়ে মদও খায়। সৎ ছেলেমেয়ে দুটোই নীচ প্রকৃতির বিপিতা যে চোখের বালি–তা সোজাসুজি জানাতে দ্বিধা করেনি কোনওদিনই। ব্যাবসার চাপে মি. কেভও নিশ্চয় মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি। রুপোর চামচ মুখে দিয়ে ধরায় আগমন ঘটেছিল ভদ্রলোকের, পেটে মোটামুটি বিদ্যেও আছে। মাসের পর মাস মানসিক অত্যাচার সইবার ফলে ঘুমাতে পারত না রাত্রে। বিষণ্ণ হয়ে থাকত সারাদিন। পাছে কেউ বিরক্ত হয়, তাই গভীর রাতে শয্যা ছেড়ে উঠে ঘুরঘুর করত বাড়িময়, একদিন রাত তিনটের সময়ে ঢুকেছিল দোকান ঘরে।
অন্ধকার ঘর, অথচ চাপা দ্যুতি দেখা যাচ্ছে একদিকে। শোকেসের দিকে। ভাঙা খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে সরু আলোকরেখা পড়েছে ক্রিস্টাল ডিমের ওপর এবং ঝলমল করছে ডিম্বাকার ক্রিস্টাল। আলোকরেখা যেন আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলেছে ক্রিস্টালের ভেতরটা।
দেখেই বৈজ্ঞানিক কৌতূহল মাথচাড়া দিয়েছিল মি. কেভের মনে। বিজ্ঞান সে পড়েছে– বিজ্ঞানকে ভাঙিয়েই তার যা কিছু রোজগার। খটকা লেগেছিল সেই কারণেই। ক্রিস্টালের মধ্যে আলোক প্রতিসরণ হয় কী করে, তা তার জানা। কিন্তু ক্রিস্টালের মধ্যে আলো ছড়িয়ে পড়ে কী করে, তা তো জানা নেই!
ক্রিস্টালটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে গিয়ে আরও বেশি গুলিয়ে গেল মাথাটা। আলো স্থির নয়–যেন সরে সরে যাচ্ছে ক্রিস্টালের মধ্যে। তালগোল পাকিয়ে যেন নেচে নেচে বেড়াচ্ছে!
আশ্চর্য ব্যাপার তো! ক্রিস্টাল নয়, যেন দ্যুতিময় বাষ্প-ভাত ফোঁপরা কাচের বর্তুল!
আচমকা আলোকরেখা আর ক্রিস্টালের মাঝখানে এসে পড়েছিল মি. কেভ। তা সত্ত্বেও দ্যুতি কমেনি ডিমটার। ঝলমলে ক্রিস্টাল ডিম নিয়ে ঘরের সবচেয়ে অন্ধকারে যাওয়ার পরেও দেখা গেছে, আলো যেন ফেটে পড়ছে আশ্চর্য ক্রিস্টালের ভেতরে। মিনিট চার-পাঁচ ঝলমলে থাকার পর আস্তে আস্তে ফিরে এসেছে দ্যুতি। একেবারে নিবে যাওয়ার পর আবার খড়খড়ির সামনে আলোকরেখার সামনে রাখতেই সঙ্গে সঙ্গে আলো ঝলমলে হয়ে উঠেছে আজব ক্রিস্টাল।
অদ্ভুত উপাখ্যানের এই অংশটুকু কিন্তু যাচাই করা হয়েছে-মিথ্যে বলেনি মি. কেভ। এক মিলিমিটারের সরু ব্যাসের আলোকরেখার সামনে ক্রিস্টাল ডিম রেখে একই কাণ্ড দেখেছে মি. ওয়েস। সবার চোখে সমানভাবে কিন্তু ধরা দেয়নি আশ্চর্য ক্রিস্টালের অত্যাশ্চর্য আলোকপ্রভা। পাস্তুর ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক মি. হারবিঞ্জার কিছুই দেখেননি। মি. ওয়েস দেখেছে বটে–কিন্তু মি. কেভের মতো নয়। মি. কেভও শরীর যখন খুব খারাপ গিয়েছে, ক্লান্তিতে যখন ভেঙে পড়েছে–তখনই অনেক বেশি স্পষ্টভাবে দেখেছে। ক্রিস্টালের ভেতরকার আজব কাণ্ডকারখানা।
প্রথম থেকেই মি. কেভ কিন্তু অবিশ্বাস্য এই অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বলতে সাহস পায়নি–বেমালুম চেপে গিয়েছে। অষ্টপ্রহর যাকে দাঁতে পেষা হচ্ছে, তার পক্ষে এরকম লুকোচুরি খুবই স্বাভাবিক। বললেই তো অত্যাচার বাড়ত। তাই ফাঁক পেলেই ক্রিস্টাল ঘুরিয়ে দেখত একাই-কাকপক্ষীকেও জানায়নি। ক্রিস্টাল যেন তাকে পেয়ে বসেছিল। লক্ষ করেছে, ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিস্টালের আলো অন্যের চোখে অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন জিনিসটা নেহাতই একটা ক্রিস্টাল ডিম ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু রাত ঘনিয়ে এলেই তার ওপর আলো ফেললে জীবন্ত হয়ে ওঠে যেন ডিমটা। দিনরাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে আরও অনেক আবিষ্কার করেছে মি. কেভ। যেমন, দিনের বেলাতেও বিশেষ কোণ থেকে দেখলে অন্ধকারের মধ্যেও আলোময় ক্রিস্টালের মধ্যে দেখা যায় অদ্ভুত দৃশ্য।
সবচেয়ে ভালো দেখা যায় বিকেলের দিকে। খাণ্ডারনি বউ যখন খেয়েদেয়ে নাক ডাকাত ওপরে, মি. কেভ তখন কাউন্টারের তলায় কালো ভেলভেট ডবল ভাঁজ করে মাথা মুখের ওপর ঢেকে চেয়ে থাকত ক্রিস্টালের দিকে। এইখানেই একদিন দেখলে, আলোকরেখা থেকে ১৩৭ ডিগ্রি কোণে চোখ রাখলে ক্রিস্টালের মধ্যে দেখা যায় অদ্ভুত একটা দেশ। নিছক ছবি নয়, যেন প্রাণস্পন্দনে ভরপুর একটা দৃশ্য। যেন সত্যিই সে দেশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মি. কেভনড়ে নড়ে যাচ্ছে ছবিটার মধ্যে অনেক জিনিস। আলো যত ভালোভাবে পড়ে, চারদিক যত অন্ধকার হয়–আশ্চর্য সেই জীবন্ত দৃশ্য ততই স্পষ্ট দেখা যায়। আলোকরেখা বা চোখের অবস্থানে তিলমাত্র হেরফের ঘটলেই জীবন্ত দৃশ্যটাও পট পালটায়। যেন একটা গোল কাচের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে আছে সত্যিকারের প্রাণময় জীবনধারার দিকে–প্রাণচাঞ্চল্যে স্পন্দিত সেই দেশের হরেকরকম দৃশ্যপট ঝলক দিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিকোণ এবং আলোকব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে।