পাঁচ পাউন্ড কি কম কথা! মন্তব্য প্রকাশ করে সৎ-মেয়ে। পরের ব্যাপারে নাক গলাতে ওস্তাদ।
বেচারা মি. কেভ। তিন-তিনটে তোপের মুখে পড়ে কান-টান লাল করে যুক্তিবুদ্ধি এক্কেবারে গুলিয়ে ফেলল। তাড়া খেয়ে আধ-খাওয়া খাবার ফেলেই সরে পড়ল দোকানঘর বন্ধ করতে। পেছন থেকে শুনল গজগজানি, এদ্দিন ধরে শোকেসে ডিমখানা ফেলে রাখার কোনও মানে হয়?
সত্যিই হয় না। ওইখানেই তো ভুল করে বসেছে মি. কেভ। বিক্রি না করে এখন উপায় নেই।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিপিতাকে আর-এক হাত নিয়ে পাড়া বেড়াতে বেরল সৎ-ছেলে আর সৎ-মেয়ে। গরম জলে লেবু-চিনি মিশিয়ে শরবত খেতে বসল কেভ-গৃহিণী ওপরতলায়। মি. কেভ কিন্তু রয়ে গেল দোকানঘরেই, অনেক রাত পর্যন্ত। কী করল দোকানে, তা নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার, পরে প্রকাশ করা যাবে। পরের দিন সকালে কেভ-গৃহিণী দেখলে সামনের শোকেস থেকে ডিমটাকে সরিয়ে এনে রাখা হয়েছে মাছ ধরার খানকয়েক পুরানো বইয়ের পাশে, এমন জায়গায় যে খদ্দেরদের চোখে চট করে পড়বে না। মাথা দপদপ করছিল বলে কথা না বাড়িয়ে ডিমটাকে চোখে পড়ার মতো জায়গায় রেখে দিলে কেভ-গৃহিণী। তিলমাত্র বাগড়া দিলে না মি. কেভ। কথাও বলল না। সারাদিনটা কাটল কিন্তু খিটখিটে মেজাজে। বিকেল নাগাদ যথারীতি ঘুমাতে গেল কেভ গৃহিণী। সেই ফাঁকে শোকেস থেকে ডিমটাকে ফের সরিয়ে দিলে মি. কেভ।
পরের দিন সকালে স্থানীয় স্কুলে মাছ দিয়ে আসতে গেল মি. কেভ ক্লাসে কেটেকুটে বিজ্ঞান শেখানোর জন্যে দরকার। ঠিক ওই সময়ে দোকানে এল কেভ-গৃহিণী ক্রিস্টাল ডিম দেখতে। ডিমটা বিক্রি হয়ে গেলে ওই পাঁচ পাউন্ড কীভাবে খরচ করা হবে, তার একটা ফিরিস্তি খাড়া হয়ে গিয়েছিল মাথার মধ্যে এর মধ্যেই। খুবই লম্বা ফর্দ। তার মধ্যে আছে। নিজের জন্যে একটা সবুজ সিল্কের পোশাক আর রিচমন্ডে বেড়িয়ে আসা। কিন্তু ডিম দেখবার আগেই উত্তপ্ত মেজাজে দোকানে এল এক খদ্দের। আগের দিন ব্যাং দেওয়ার কথা ছিল, দেওয়া হয়নি কেন? স্বামীমশায়ের এই ব্যাং ব্যাবসাটা কোনওদিনই সুনজরে দেখেনি কেভ-গৃহিণী। ব্যাঙের খদ্দেরকেও তাই মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনিয়ে বার করে দিলে দোকান থেকে। তারপর দেখতে গেল, ডিমটা ঠিক জায়গায় আছে কি না, ওই ডিমই যে নিয়ে আসবে কড়কড়ে পাঁচটা পাউন্ড… পূর্ণ হবে তার স্বপ্ন।
ও মা! ডিম তো নেই শোকেসে!
সওয়া দুটো নাগাদ ফিরে এসে মি. কেভ দেখলে, মেঝের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে মরা জানোয়ারের ভেতরে খড়কুটো ঠাসার সরঞ্জাম টেনে নামাচ্ছে তার বউ। দোকানঘর তছনছ। কোনওখানেই দেখতে বাকি রাখেনি কেভ-গৃহিণী। স্বামীরত্নকে দেখেই ঝাঁপাই জুড়াল চোখ পাকিয়ে–আস্পদ্দা তো কম নয়! লুকিয়ে রাখা হয়েছে?
লুকিয়ে রেখেছি? কী বল তো?
ন্যাকা আর কী! ডিমটা… ডিমটা… কোথায় রেখেছ?
ডিম! শোকেসের সামনে ছুটে গিয়ে যেন আকাশ থেকে পড়ল মি. কেভ–কী আশ্চর্য! গেল কোথায়?
ঠিক সেই সময়ে খেতে এসে খাবার না পেয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দোকানে ঢুকল মি. কেভের সৎ-ছেলে। ক্রিস্টাল ডিম নিপাত্তা হয়েছে শুনে রাগটা মায়ের ওপর থেকে সরে এসে পড়ল বিপিতার ওপর। মা আর ছেলে মিলে নির্মমভাবে দুষতে থাকে মি. কেভকে– পাছে বেচতে হয়, তাই লুকিয়ে রেখেছে নিজেই। পালটা অভিযোগ নিয়ে এল মি. কেভ– টাকার লোভে নিশ্চয় তাকে না জানিয়ে বেচে দেওয়া হয়েছে ক্রিস্টাল।
ফলে লাগল তুমুল ঝগড়া। ঝগড়ার পর দেখা গেল, মৃগীরুগির মতো হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা নিয়ে রণে ভঙ্গ দিচ্ছে কেভ-গৃহিণী। আর, কর্মক্ষেত্রে আধ ঘণ্টা দেরি করে পৌঁছাল সৎ-ছেলে। ক্ষিপ্ত বউকে আর না ঘাঁটিয়ে দোকানে বসে মাথা ঠান্ডা করতে লাগল মি. কেভ।
সন্ধের সময়ে আবার খাওয়ার টেবিলে শুরু হল চেঁচামেচি। এবার আক্রমণ চলল সৎ মেয়ের নেতৃত্বে। সহ্য করতে না পেরে দড়াম করে দরজা খুলে চম্পট দিল মি. কেভ। সেই ফাঁকে চিলেকোঠা থেকে পাতাল কুঠুরি পর্যন্ত সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে দেখেও ক্রিস্টাল ডিমকে কিন্তু পাওয়া গেল না।
পরের দিন খদ্দের দুজন দোকানে আসতেই সজল চোখে কেভ-গৃহিণী তাদের খাতির করে বসিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে শুনিয়ে দিলে তার অসীম দুঃখ-দুর্দশার নানান কাহিনি। সবার মূলে ওই মি. কেভ। জীবনটা নাকি মাঠে মারা যেতে বসেছে কেভের সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার পর থেকে। কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ। তাকে তো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারছেই, ক্রিস্টাল ডিমটাকে নিয়েও কী খেলাই না খেলছে। কেভের সারাজীবনটাই এইরকম নষ্টামিতে ভরতি। পাদরি সাহেব যদি ঠিকানাটা দিয়ে যান, তাহলে বাড়ি বয়ে গিয়ে একদিন শুনিয়ে আসবে। সকৌতুকে সব শুনে ঠিকানা দিয়ে গিয়েছিল পাদরি। কিন্তু সে ঠিকানা হারিয়ে যাওয়ায় পাদরিকে আর খুঁজে পায়নি কেভ-গৃহিণী।
সন্ধে হলে দম ফুরিয়ে ঝিমিয়ে পড়ল গোটা কেভ পরিবার। মি. কেভকে একা একাই খেতে হল রাতের খাবার–আগের দুরাতের ঝড় বইল না খাওয়ার টেবিলে। পুরো বাড়িটা কিন্তু থমথম করতে লাগল এই ব্যাপারের পর থেকে।
ক্রিস্টাল ডিম কিন্তু আর ফিরে এল না–এল না খদ্দেররাও।
কেচ্ছাকাহিনির মধ্যে না গিয়ে এককথায় বলা যায়, মি. কেভ পয়লা নম্বরের মিথ্যুক, ক্রিস্টাল ডিমটা সরিয়েছিল সে নিজেই। মাছের থলির মধ্যে করে নিয়ে গিয়ে রেখে এসেছিল সেন্ট ক্যাথরিনস হসপিটালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিমনস্ট্রেটর মি. জ্যাকোবি ওয়েসের কাছে। ক্রিস্টাল ডিম রয়েছে সেখানেই–আমেরিকান হুইস্কির পাশে কালো ভেলভেট-ঢাকা অবস্থায়। সব কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি মি. ওয়েস। তবে কেভ-দম্পতির মধ্যে যে নিরন্তর খিটিরমিটির লেগেই আছে–তা জানত, মি. কেভের মুখেই শুনেছিল। মিসেস কেভকেও দেখেছিল, বিচিত্র চরিত্র ভালো লাগত বলেই মি. কেভকে তার ভারী পছন্দ। তাই ক্রিস্টাল ডিম রেখে দিতে আপত্তি করেনি। সামান্য একটা ডিমের ওপর কেন মি. কেভের মায়া পড়ে গেছে, তা পরে বিস্তারিতভাবে বলবে বলেছিল ভদ্রলোক। তবে হ্যাঁ, ডিমের মধ্যে নাকি মরীচিৎকার মতো অনেক ছায়াবাজি সে দেখেছে–সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।