রোজ যে সময়ে ঘুম ভাঙে, পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল সেই সময়ে। গুম হয়ে খেয়ে গেল প্রাতরাশ। একটাই চিন্তা চরকিপাক দিচ্ছে মাথার মধ্যে। কাল রাতের উদ্ভট কাণ্ডকারখানাগুলো জলজ্যান্ত স্বপ্ন নয় তো? অনেকক্ষণ পরে ইচ্ছে হয়েছিল সাবধানে আরও কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করার। যেমন, তিনটে ডিম খেল ব্রেকফাস্টে। ল্যান্ডলেডির দেওয়া দুটো, তৃতীয়টা বানিয়ে নিল শূন্য থেকে। অলৌকিক হাঁসের ডিম। অনেক তাজা, অনেক সুস্বাদু ডিম পাড়া হল টেবিলে, সেদ্ধও হয়ে গেল টেবিলে এবং প্লেটে এসে পড়ল অসাধারণ ইচ্ছাশক্তির দৌলতে। চাকুরিস্থলে গেল হন্তদন্ত হয়ে ভেতরের উত্তেজনাকে প্রাণপণে চেপে রেখে। সেই রাতেই ল্যান্ডলেডি অবশ্য বিস্ময় প্রকাশ করেছিল, তৃতীয় ডিমটার খোলা টেবিলে এল কোত্থেকে, ভেবে পায়নি কিছুতেই।
অফিসের কাজ কিন্তু কিছু হয়নি সারাদিনে। তাতে কোনও অসুবিধেও হয়নি। সারাদিন। নিজের অলৌকিক ক্ষমতার চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকবার পর দিনের শেষে শেষ দশ মিনিটে প্রয়োগ করেছিল বিচিত্র ইচ্ছাশক্তিকে। সারাদিনের স্তূপীকৃত কাজ সমাধা হয়ে গিয়েছিল ওই দশ মিনিটেই! দিনটা শুরু হয়েছিল অপরিসীম বিস্ময়বোধ দিয়ে শেষ হল আত্যন্তিক উল্লাসবোধে। অতিমানুষ হওয়ার পরমোল্লাস! লং ড্রাগন পানশালা থেকে বিতাড়িত হওয়ার মূর্তিটা ওরই মধ্যে কাঁটার মতো খচখচ করে বিধতে লাগল মনের মধ্যে। ঘটনাটা সহকর্মীরাও শুনেছিল। তা-ই নিয়ে একটু-আধটু হাসিঠাট্টাও সহ্য করতে হল। ভঙ্গুর পদার্থ শূন্যে উত্তোলনের ব্যাপারে এখন থেকে সতর্ক থাকাই ভালো। তবে, ঈশ্বরপ্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতাটার অসীম সম্ভাবনা ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে এনেছিল ফোদারিনগেকে। অন্যান্য ভেলকির ফাঁকে ফাঁকে বাড়িয়ে নিয়েছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তিও। যেমন, একজোড়া হীরকখচিত শার্টের বোতাম। শূন্য থেকে বোতামজোড়া আবির্ভূত হতে না-হতেই সাত তাড়াতাড়ি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল শূন্যের মধ্যেই–একজন ছোকরা সহকর্মীকে টেবিলের দিকে আসতে দেখেই। হীরের বোম এল কোত্থেকে, এই নিয়ে জবাবদিহি করতে গিয়ে আবার না ফ্যাসাদে পড়তে হয়। অদ্ভুত ক্ষমতাটাকে রয়েসয়ে ভেবেচিন্তে হিসেব করে কাজে লাগানো দরকার। এমন কিছু কঠিন কৌশল অবশ্য নয়– সাইকেল চালানো শেখার মতোই। প্রথমদিকে একটু-আধটু দুর্ঘটনা ঘটেই–তারপর জল ভাত। কিন্তু প্র্যাকটিস তো দরকার। সেটা লং ড্রাগন পানশালায় সম্ভব নয়। আবার কেলোর কীর্তি আরম্ভ হয়ে যেতে পারে। তাই এল গ্যাস কারখানার পেছনে নিরিবিলি সরু গলিটায় –পাঁচজনের চোখের আড়ালে।
কিন্তু মৌলিকতা দেখাতে পারেনি নিরিবিলি প্র্যাকটিসেও। ইচ্ছাশক্তির বলে বলীয়ান হলেও, মানুষ হিসেবে তো ফোদারিনগে অতিশয় মামুলি টাইপের। একবার ভাবল, হাতের ছড়িটাকে বিষধর সাপ বানালে কেমন হয়? তারপর? এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে অলৌকিক সৰ্পৰ্মহাশয়কে বাগে রাখবে কে? অনর্থ ঘটিয়ে বসবে যে। তার চাইতে বরং ছড়িটাকে বলা যাক ফুলের গাছ হয়ে যেতে।
হুকুমটা মুখ থেকে খসতে-না-খসতেই ফুটপাতের কিনারায় গজিয়ে উঠল ভারী সুন্দর ফুলের ঝোপ। ঠিক এই সময়ে কানে ভেসে এসেছিল ভারী বুটের শব্দ। সর্বনাশ! মির্যাকূলের জবাবদিহি করতে হলেই তো গেছে ফোদারিনগে! সাত তাড়াতাড়ি হুকুম দিয়েছিল ফুলের গাছকে–দূর হ!
বলা উচিত ছিল–ছড়ি হ! কিন্তু হুটোপাটি করতে গিয়ে বেমক্কা হুকুমটা বেরিয়ে গিয়েছিল মুখ দিয়ে। বাস! সাঁই সাঁই করে ভীষণ গতিবেগে দূরে চলে গিয়েছিল ফুল-ধরা ছড়ি এবং ক্রুদ্ধ গালাগাল ভেসে এসেছিল দূর থেকে। চলমান ফুলছড়ি দমাস করে আছড়ে পড়েছে আগুয়ান পুরুষটার গায়ে। কে রে বেল্লিক! ছড়ি ছোঁড়ার এই কি জায়গা? থুতনিটা যে আর-একটু হলে খসে যেত!
সরি, বলেই আরও ঘাবড়ে গিয়ে গোঁফে তা দিতে শুরু করেছিল ফোদারিনগে কনস্টেবল উইঞ্চকে আসতে দেখে।
ফোদারিনগেকে দেখেই চিনতে পেরেছিল উইঞ্চ। জখম থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে সে কী ঝাঁপাই! লং ড্রাগন পানশালায় লম্ফ তোবড়ানোর পর আবার কী নষ্টামি আরম্ভ হল অন্ধকার গলিতে? বলি, ব্যাপারটা কী? পুলিশের ওপর হাঙ্গামা? ফাটকে ঢোকার শখ হয়েছে বুঝি? চুপ কেন? অ্যাঁ?
আমতা আমতা করে বলতে গিয়েছিল ফোদারিনগে, মিরাকলের জন্যেই নাকি ঘটছে। এইসব অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার। কিন্তু মুখ দিয়ে মির্যাল শব্দটা বেরতে-না-বেরতেই তেড়ে উঠেছিল কনস্টেবল উইঞ্চ।
সর্বনাশ! গুপ্ত রহস্য আর তো গুপ্ত থাকবে না! এখুনি শুরু হবে পুলিশি জেরা। নিজের ওপরেই বিষম রাগ হয়ে গিয়েছিল ফোদারিনগের। উইঞ্চের তড়পানিরও ইতি করা দরকার। ঝটিতি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, কান ঝালাপালা করে দিলে দেখছি। মির্যাল দেখতে চাও তো? বেশ তো, দেখে যাও একটু হাতসাফাইয়ের ভেলকি! হেডস যাও– এখুনি!
বাস, ফুটপাতে আবার একা হয়ে গিয়েছিল ফোদারিনগে!
সে রাতে আর মিরাকল ঘটায়নি অঘটন ঘটানোর আজব মানুষটা। ফুলে ফুলে ভরে ওঠা ছড়িটার অবস্থা কী হল, তা নিয়েও আর মাথা ঘামায়নি। ফিরে এসেছিল শহরে। ভয়ে ভয়ে, এক্কেবারে ঠান্ডা মেরে। মুখে আর কথাটি নেই। নিঃশব্দে ঢুকেছিল নিজের শোবার ঘরে। তারপর শুরু হয়েছিল স্বগতোক্তি, জয় ভগবান! এ কী ক্ষমতা দিলে আমাকে! হুকুমের এত জোর? কল্পনাও করা যায় না! হেডস জায়গাটা কেমন, তা-ও তো ছাই জানি না।