বছরখানেক আগেও ছিল দোকানটা। ছোট্ট এবং অত্যন্ত নোংরা। সেভেন ডায়ালস-এর কাছেই। রোদে-জলে ফিকে হয়ে এসেছিল হলুদ অক্ষরে লেখা নামটা:
–প্রকৃতিপ্রেমিক মি. কেভ।
–পুরানো জিনিসের দোকান।
শোকেসগুলোয় ঠাসা থাকত অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস। হাতির দাঁত, বেজোড় দাবার খুঁটি, পুঁতি, অস্ত্রশস্ত্র, এক বাক্স চোখ, দুটো বাঘের করোটি, একটা নরকরোটি, পোকায় খাওয়া কয়েকটা খড় আর কাঠের কুঁচো ঠাসা বাঁদর (একটা বাঁদর লম্ফ ধরে আছে), মান্ধাতার আমলের একটা ক্যাবিনেট, অস্ট্রিচের ডিম কয়েকখানা, মাছ ধরার কিছু সরঞ্জাম, একটা অসাধারণ নোংরা, শূন্য কাচের মাছ-চৌবাচ্চা।
ছিল আরও একটা বস্তু, এই গল্প শুরু হওয়ার সময়ে। ডিমের আকারে একতাল ক্রিস্টাল। খুব চকচকে পালিশ করা। দুই ব্যক্তি বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিল একদৃষ্টে। একজন পাদরি। লম্বা, শীর্ণ আকৃতি। অপরজন বয়সে তরুণ। গালে কালো দাড়ি। গায়ের রং কালচে। জামাকাপড় চোখে পড়ার মতো নয়।
ডিমটার দিকে এমনভাবে আঙুল তুলে দেখাচ্ছিল ছোকরা যেন কেনবার জন্যে পীড়াপীড়ি করছে পাদরিকে।
এমন সময়ে দোকানে এল মি. কেভ। সবে চা খেয়ে এসেছে। মাখন আর রুটি লেগে রয়েছে ঝোলা দাড়িতে৷ দুজন খদ্দের দাঁড়িয়ে ডিম দেখছে দেখেই ঝুলে পড়ল চোয়াল। চোরের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পেছনদিকে এবং আলতো করে ভেজিয়ে দিলে দরজা।
মি. কেভের বয়স হয়েছে। খর্বকায় পুরুষ। ফ্যাকাশে মুখ-চোখ দুটো অদ্ভুত নীল–যেন জল টলটল করছে। চুল ধূসর এবং ময়লা। গায়ে নোংরা ফ্রক-কোট। মাথায় মান্ধাতার আমলের টুপি। পায়ে গোড়ালি ক্ষয়ে চুন-হয়ে-যাওয়া কার্পেট-চটি।
শোকেসের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে দুজন–মি. কেভও চেয়ে আছে তাদের দিকে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠো খুচরো বার করে মুচকি হাসল পাদরি–ভাবখানা, কুলিয়ে যাবে এই পয়সাতেই। দেখেই কিন্তু আরও ঘাবড়ে যায় মি. কেভ। মুখ একেবারেই শুকিয়ে গেল দুই খদ্দের দোকানে ঢুকতেই।
গৌরচন্দ্রিকার ধার দিয়েও গেল না পাদরি–দাম জানতে চাইল ডিমটার। ভয়ে ভয়ে পেছনে অন্দরমহলের দরজায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে পাঁচ পাউন্ড দাম হাঁকল মি. কেভ।
এত দাম? হতেই পারে না।–সে কী রাগ পাদরির। হতে যে পারে না, তা কি জানে না মি. কেভ? জেনে-শুনেই হেঁকেছে চড়া দাম। ফলে শুরু হয়ে গেল দর কষাকষি।
কিন্তু কথা না বাড়িয়ে দোকানের দরজা খুলে ধরে মি. কেভ জানিয়ে দিলে, পাঁচ পাউন্ডের এক পাই কম হবে না।
ঠিক এই সময়ে অন্দরের দরজার ওপরকার কাঁচে দেখা গেল একটি স্ত্রী-মুখ। নির্নিমেষে চেয়ে আছে খদ্দের দুজনের দিকে। গলা কেঁপে গেল মি. কেভের।
এতক্ষণ চুপ করে দর কষাকষি শুনছিল ছোকরা। তীক্ষ্ণ চাহনি ঘুরছিল চারদিকে।
হঠাৎ বললে, পাঁচ পাউন্ডই দিন।
আপত্তি জানালে পাদরি। কিন্তু ধোপে টিকল না। ব্যাজার মুখে পকেট হাতড়ে দেখলে, তিরিশ শিলিং-এর বেশি হচ্ছে না। এই সুযোগে বোঝাতে লাগল মি. কেভ, ক্রিস্টাল ডিমটা নাকি বিক্রির জন্য নয়। বিক্রির জন্যে নয় তো দর হাঁকা হল কেন?–জানতে চায় দুই খদ্দের। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মি. কেভ বলে, বিকালেই একজন লোক এসেছিল তো। কিনবে বলে গেছে। তাই একটু দর চড়িয়ে নিরাশ করতে চেয়েছিলাম।
এমন সময়ে খুলে গেল অন্দরের দরজা। দরজার ওপরকার কাচ দিয়ে এতক্ষণ উঁকি দিচ্ছিল যে, দোকানে ঢুকল সে।
স্থূল, কর্কশ-আকৃতি এক স্ত্রীলোক। মি. কেভের চেয়ে বয়স কম–কিন্তু আয়তনে অনেক বড়। ভারী ভারী পা ফেলে মুখ লাল করে বললে, কে বললে, বিক্রি হবে না ক্রিস্টাল ডিম? আলবত হবে। বিক্রির জন্যেই রাখা হয়েছে। পাঁচ পাউন্ড তো ভালো দাম। কেভ, ভদ্রলোকদের ফিরিয়ে দিচ্ছ কেন শুনি?
বাধা পেয়ে ভীষণ রেগে গেল কেভ। কটমট করে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে কড়া গলায় জানিয়ে দিলে ব্যাবসাটা তার, চালাতে হয় কী করে, সে জ্ঞানও তার আছে।
শুরু হয়ে গেল কথা কাটাকাটি। মজা পেয়ে কেভ-গৃহিণীকে উসকে দিতে থাকে খদ্দের দুজন। বড়ই কোণঠাসা হয়ে পড়ে মি. কেভ বেচারি, কিন্তু গোঁ ছাড়ে না কিছুতেই।
কথা কাটাকাটির অবসান ঘটায় প্রাচ্যের সেই ছোকরা। বিকেল নাগাদ যে লোকটা ক্রিস্টাল ডিম কেনবার আগ্রহ দেখিয়ে গেছে, সে যদি ইতিমধ্যে নিয়ে যায় যাক, কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু যদি না নেয়, দুদিন পরে এসে পাঁচ পাউন্ড দাম দিয়েই ক্রিস্টাল ডিম নিয়ে যাবে তারা।
বিদেয় হল দুই খদ্দের। চরমে উঠল স্বামী-স্ত্রীর কোঁদল। রাগের মাথায় উলটো-পালটা বকতে থাকে মি. কেভ। একবার বলে, আগে যে কিনতে এসেছে, ক্রিস্টাল ডিম তারই প্রাপ্য। তাহলে পাঁচ পাউন্ড চাইলে কেন? সে কী তম্বি কেভ-গৃহিণীর। ব্যাবসাটা যেন তারই, হুকুম দিতে পোক্ত। তেলে-আগুনে জ্বলে উঠে মি. কেভ শুনিয়ে দিলে মুখের ওপর, আমার ছাগল, আমি মাথায় কাটি কি লেজে কাটি, তোমার কী দরকার?
রাতে খেতে বসে আবার শুরু হল ঝগড়া ক্রিস্টাল ডিম নিয়ে। এবার মায়ের দলে ভিড়েছে মি. কেভের সৎ-ছেলে আর সৎ-মেয়ে। তিনজনের কারওই উচ্চধারণা নেই মি. কেভের ব্যাবসা-বুদ্ধি সম্পর্কে।
সৎ-ছেলের বয়স আঠারো, সৎ-মেয়ের বয়স ছাব্বিশ। বড় তার্কিক।
তেড়েমেড়ে বললে সৎ-ছেলে, বেশি বোঝে। এর আগেও ডিমটা পাচার করার ব্যাপারে আমার মতামতকে পায়ে মাড়িয়ে গেছে।