ভেবেছিলাম, মেজাজ ঠান্ডা হলেই শয়তানের বাচ্চা সব ভুলে যাবে। ব্রেন আর কতটুকু। তারপর মওকা বুঝে নেমে আসব। মাছ নিয়ে আস্তে আস্তে কাছে গেলেই আহ্লাদে আটখানা হবে। আবার আগের মতো সবকিছু হয়ে যাবে। কিন্তু হাড় বদমাশটার হাড়ে হাড়ে যে শয়তানি আর কুচুটেপনা–তা তখনও বুঝিনি। নেমকহারামির জন্যে লজ্জা পাওয়া দূরে থাক, বিটলে বাচ্চার রক্তে ক্ষমাঘেন্না জিনিসটা যে একেবারেই নেই, সে শিক্ষা হল বড় কষ্টের মধ্যে দিয়ে।
মাথা খাটিয়ে অনেক ফিকির, অনেক কায়দা আবিষ্কার করেছিলাম বেল্লিকটাকে বশ করতে। সব আর বলব না। কিন্তু হার মেনেছি প্রতিবারেই। নরকের পোকা কোথাকার! এখনও ভাবলে লজ্জায় মাথা হেট হয়, গাল লাল হয়! শেষকালে খোশায়োদ ছেড়ে মারধর করেছিলাম। প্রবালের ডেলা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতাম দূর থেকে। কোঁত কোঁত করে গিলে ফেলত। খোলা ছুরি টিপ করে ছুঁড়ে ছিলাম। বড় ছুরি বলে গিলতে পারেনি–কিন্তু ছুরি ফিরিয়ে আনতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। না খাইয়ে মারবার মতলব এঁটেছিলাম। মাছ ধরাই ছেড়ে দিলাম, হারামজাদা অল্প জলে নেমে পোকা খুঁটে খুঁটে খেতে আরম্ভ করল। অর্ধেক সময় গলা-জলে ডুবে বসে থাকতাম, বাকি অর্ধেক তাল গাছের ডগায়। একটা গাছ ছিল পেল্লায় উঁচু। শয়তানের বাচ্চা একদিন সেখানেও নাগাল ধরে ফেলল। ঠোক্কর মেরে আমার পায়ের ডিম থেকে এক চাকলা মাংস খুবলে নিয়ে গেল। সে কী অসহ্য যন্ত্রণা! ওই অবস্থায় তাল গাছে ঘুমানো যায়? আপনি পারবেন? সারারাত দুঃস্বপ্ন দেখেছি, চমকে চমকে উঠেছি।
কী লজ্জা! কী লজ্জা! আমারই দ্বীপে রাজার মতো হেলেদুলে টহল দিচ্ছে লোপ পেয়ে যাওয়া একটা জানোয়ার, পায়ের চেটো ছোঁয়াতে দিচ্ছে না মাটিতে। লজ্জার মাথা খেয়ে বলছি, শেষকালে কান্নাকাটিও করেছি ক্লান্তিতে। আশা মিটিয়ে গালাগালও দিয়েছি। এ কী নষ্টামি? আমারই দ্বীপে আমাকে তাড়িয়ে গাছের ডগায় তুলে দেওয়া! জাহান্নমে যেতে বলেছি যতবার, ততবারই তেড়ে এসে এমন ঠোক্কর মেরেছে যে, পালাবার পথ পাইনি। ভয়ে কাঁটা হয়ে থেকেছি খোদ শয়তান–পাখি না কচু! দেখতে যেমন জঘন্য, স্বভাব চরিত্রও তা-ই? ছি! ছি!
এই অবস্থা বেশি দিন চলতে পারে না। বেদম হয়ে পড়েছিলাম। শেষে মাথায় খুন চাপল। দক্ষিণ আমেরিকায় দড়ির ফাঁস ছুঁড়ে যেভাবে জানোয়ার ধরে, সেইভাবে হারামজাদাকে কুপোকাত করব ঠিক করলাম। মাছ ধরার দড়ি যা কিছু ছিল, সব একটার পর একটা বাঁধলাম। লম্বায় হল প্রায় বারো গজ। একদিনে হয়নি। ল্যাগুন থেকে লম্বা লম্বা ঘাস আর আঁশ তুলে কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি জলে, কখনও গাছের ডগায়। তারপর দুটো বড়সড়ো প্রবালের টুকরো বাঁধলাম দড়ির ডগায়। গলা-জলে ডুবে বসে থেকে মাথার ওপর বনবন করে ঘুরিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিলাম শয়তানের বাচ্চার দিকে। জড়িয়ে গেল দুপায়ে। যত লাফায়, তত বেশি জড়ায়। শেষকালে উলটে পড়তেই উঠে এলাম জল ছেড়ে। ছুরি দিয়ে কাটলাম গলা…
ভাবলেও মনটা খারাপ হয়ে যায় আজও। মানুষ খুন করছি যেন মনে হয়েছিল। কিন্তু রাগে তখন মাথায় আগুন জ্বলছে। বালির ওপর রক্তের পুকুরে সুন্দর পা আর বাহারি গলা মুচড়ে যন্ত্রণায় ছটফটানির দৃশ্য আজও ভাসছে চোখের সামনে।
সেই থেকে নিঃসঙ্গতা অসহ্য হয়ে উঠল। ডিম থেকে বার করে যাকে বড় করেছিলাম, দিনের পর দিন কত মজার খেলা খেলে আমার নিঃসঙ্গতাকে যে ভরিয়ে রেখেছিল–সে না থাকায় খাঁ খাঁ করতে লাগল চারদিক। অসহ্য! অসহ্য! একেবারে মেরে ফেলাটা ঠিক হয়নি, জখম করলেই পারতাম। তারপর না হয় সেবাশুশ্রূষা করে আবার চাঙ্গা করে তোলা যেত। প্রবাল পাহাড় খোঁড়বার সরঞ্জাম ছিল না সঙ্গে। থাকলে, পাথর খুঁড়ে মানুষের মতোই তাকে কবর দিতাম। হতে পারে বেইমান জানোয়ার, আমি কিন্তু তাকে মানুষের মতোই দেখেছিলাম। ভালোবেসেছিলাম। মানুষের মাংস কি মানুষ খেতে পারে? আমিও পারিনি। জলে ফেলে দিয়েছিলাম। মাংস খেয়ে শুধু হাড়গুলো ফেলে গিয়েছিল মাছেরা। পালক পর্যন্ত রাখেনি। তারপর একদিন একটা পালতোলা জাহাজ হঠাৎ এসে গেল অ্যাটলে।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাছে উইন্সলো নামে একজন দোকানদারকে বেচে দিয়েছিলাম হাড়গুলো। সে বেচেছিল হ্যাঁভার্সকে। হ্যাঁভার্স লোকটা একটা আস্ত পাঁঠা, অত বড় হাড় দেখেও জিনিসটার কদর করতে পারেনি। তার মৃত্যুর পর হইচই আরম্ভ হল ইপাইওরনিসকে নিয়ে। নামটা দেওয়া হয়েছিল তখনই, তা-ই না? পুরো নামটা জানেন?
ইপাইওরনিস ভ্যাসটাস, বলেছিলাম আমি। গজখানেক লম্বা একখানা ঊরুর হাড় পাওয়া গিয়েছিল সবার আগে। এর চাইতে বড় হাড় আর নাকি হয় না। নাম দেওয়া হল ইপাইওরনিস ম্যাক্সিমাম। তারপর পাওয়া গেল সাড়ে চার ফুট লম্বা আর-একখানা উরুর হাড়। নাম দেওয়া হল ইপাইওনিস টাইটান। হ্যাঁভার্সের মৃত্যুর পরে পাওয়া গেল আপনার ভ্যাসটাস। তারপরেও পাওয়া গিয়েছিল ভ্যাসটিসিমাস।
মুখের কাটা দাগটায় হাত বুলিয়ে নিয়ে বুচার বললে, এখন বলুন তো মশায়, আমার সঙ্গে অমন জঘন্য ব্যবহারটা করা কি উচিত হয়েছে ইপাইওনিস ভ্যাসটাসের?
ক্রিস্টাল ডিম
ক্রিস্টাল ডিম ( The Crystal Egg)
[‘The Crystal Egg’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Pearsons Magazine’ পত্রিকায় ১৮৯৭ সালে। গল্পটি উল্লেখযোগ্য কারণ এর ঠিক এক বছর বাদে ওয়েলস ‘The War of the Worlds’ উপন্যাস হিসেবে প্রকাশ করেন, এবং এই গল্পের মঙ্গল গ্রহবাসীদের দেখতে অথবা তাদের মেশিনগুলির বর্ণনা একদম মিলে যায়। যদিও ‘The War of the Worlds’ এর মঙ্গল গ্রহবাসীদের পৃথিবী আক্রমণ নিয়ে এই গল্পে কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না, এই গল্পটিকে ‘The War of the Worlds’ জগতের পূর্বসুরি ধরা হয়। ‘Doubleday & McClure Co’. থেকে ১৮৯৯ সালে পেকাশিত হয় ‘Tales of Space and Time’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। সেপ্টেম্বর ১৯২৬ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘Amazing Stories’ পত্রিকায়।]