প্রথমদিকে মনের মতোই সঙ্গী পেয়েছিলাম। আকার-আয়তনে ছোট্ট মুরগি বললেই চলে। পাখির ছানার মতোই দেখতে–একটু যা সাইজে বড়। গোড়ায় পালক ছিল নোংরা বাদামি রঙের, ধুলো-রঙের মামড়ি একটু ছিল, খসে গেল দুদিনেই। দেখা গেল চুলের মতো পালক। নাম দিলাম তার ফ্রাইডে। রবিনসন ক্রুসোর ফ্রাইডে ছিল মানুষ-সঙ্গী। আমার ফ্রাইডে হল তিনশো বছর আগেকার দানব-পাখির ছানা। কুৎসিত। গা ঘিনঘিন করেছিল ঠিকই। কিন্তু মুরগির মতোই ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে ক্যাঁ-কোঁ আওয়াজ করে খাবার খুঁটতে শুরু করতেই মনটা হু-হুঁ করে উঠেছিল। আহা রে, মা নেই, বাবা নেই। খাবার জোগাতে হবে তো আমাকেই। ল্যাগুন থেকে কাকাতুয়া-মাছ ধরে এনে খেতে দিয়েছিলাম। দিতে-না দিতেই শেষ। আরও চাই। ঠোঁট ফাঁক করে সে কী লাফাই। মজা পেয়েছিলাম। তেমন। বুঝলে ওকেই খাওয়া যাবে। বড় হোক।
দিনরাত ঘুরত সঙ্গে ন্যাওটার মতো। মাছ ধরতাম, যখন পাশে দাঁড়িয়ে দেখত। যা মাছ উঠত, তার বখরা নিত–আমাকেও দিত। বালির ওপর একরকম আচারের শসার মতো ছোট শসা গজাত এন্তার। গায়ে ছোট ছোট আঁচিল। একদিন একটা ঠুকরেই এমন মেজাজ খিঁচড়ে গেল যে, আর এদিক মাড়ায়নি। ইন্টারেস্টিং, তা-ই না?
দিনে দিনে বেড়ে চলল ইপাইওনিস ছানা। রোজই দেখতাম যেন বাড়ছে একটু করে। দুবছর দেখেছিলাম এইভাবে। বেশ সুখে ছিলাম মশায়। কাজকর্ম নেই, মাথাব্যথাও নেই। মাইনে জমা পড়ছে ডসনের অফিসে। সময় কাটানোর জন্য দ্বীপটাকে সাজাতাম মনের মতো করে। শামুক, ঝিনুক, গেঁড়ি কুড়িয়ে এনে বালির ওপর সাজিয়ে লিখেছিলাম দ্বীপের নাম–ইপাইওরনিস আইল্যান্ড। দ্বীপের সব দিকেই। তারপর শুয়ে শুয়ে দেখতাম, জাহাজ টাহাজ আসে কি না। আশপাশে ঝাঁপাই জুড়তে দৈত্য-পাখির ছানা। বাড় দেখে অবাক হতাম। যত দিন যাচ্ছে, ততই খোলতাই হচ্ছে চেহারাটা। মাথায় নীল ঝুঁটি গজাল চোখের সামনেই, সবুজ পালক গজালো পেছনে। ঝড়বৃষ্টির সময়ে ছাউনির তলায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে থেকেছি কত দিন কত রাত। ঝড়বৃষ্টি থামলে আবার টহল দিতে বেরিয়েছি। যদি কিছু ভেসে আসে, এই আশায়; এই দুবছরে মাঝে মাঝে পালের ডগা চোখে পড়েছে। –কিন্তু দ্বীপের দিকে আসেনি কোনও জাহাজ।
বড় সুখে ছিলাম। স্বর্গসুখ বললেই চলে। তামাক ছিল না, এইটুকুই যা দুঃখের। কিন্তু এত সুখ সইল না। দ্বিতীয় বছরের শেষাশেষি কপাল ভাঙল। ফ্রাইডে তখন মাথায় চোদ্দো ফুট উঁচু। গাঁইতির ফলার মতো ইয়া মুন্ডু ঘাড়ের ওপর। মস্ত দুটো বাদামি চোখ। চোখ ঘিরে হলুদ আংটি। ঠিক মানুষের চোখের মতোই কাছাকাছি চোখ, কিন্তু মুরগির চোখের মতো দুদিকে সরানো নয়। মিহি পালক-অস্ট্রিচের পালকের মতো কর্কশ নয়। রং আর পালক দুটোই নিউ গিনির ক্যাসয়ারি বা এমু পাখির মতো অনেকটা।
কিন্তু রক্তে যার বেইমানি রয়েছে, তার বাইরে দেখে কি চেনা যায়? চেহারা যত খোলতাই হয়েছে, গায়েগতরে ভারী হয়েছে আমারই হাতে খেয়ে, ততই তিরিক্ষে হয়েছে। মেজাজ। ঘাড় বেঁকিয়ে কিনা তেড়ে আসে আমাকেই? নেমকহারাম কোথাকার!
একদিন হিমশিম খেয়ে গেলাম মাছ ধরতে গিয়ে। মাছ আর পাই না–এদিকে হারামজাদা ইপাইওরনিস সমানে ঘুরঘুর করছে আমার পাশে–মনে মনে যেন একটা মতলব আঁটছে। খিদেয় পেট জ্বলছে বুঝতে পারছি, সমুদ্রের শসা তো পড়ে রয়েছে– খেলেই হয়। শয়তানের বাচ্চার আবার তা মুখে রোচে না। অনেক কষ্টে পেলাম একখানা মাছ। পেট চুইচুই করছে আমারও। তাই ভাগ দিতে চাইনি। আরে সব্বনাশ! হোঁয়াক করে কিনা তেড়ে এসে কামড়ে নিল মাছখানা, হ্যাঁচকা টান মেরে কেড়ে নিয়ে মাথায় এক ঘা কষিয়ে দিয়েছিলাম। বাস–সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর।
মুখখানা দেখুন। আচমকা রামঠোক্করেই এই কাণ্ড। এ কাটার দাগ জীবনে আর মেলাবে? ঠোক্কর মেরেও রেহাই দিল না। কী করল জানেন? ধাঁই করে সে কী লাথি! ঘোড়ার চাট সে তুলনায় কিছুই নয়। ঠিকরে পড়েই লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছিলাম। ফের তেড়ে আসছে দেখেই দুহাতে মুখ ঢেকে দৌড়েছিলাম পাঁইপাঁই করে। কিন্তু কী বলব মশায়, হারামজাদা পক্ষিরাজের মতো সাঁইসাঁই করে তেড়ে এল। রেস-হর্সও অত জোরে ছুটতে পারে না। তারপরেই শুরু হল রামধোলাই। উফ! লাথির পর লাথি–সেই সঙ্গে ঠোক্করের পর ঠোক্কর! এক-একখানা লাথি দুরমুশের মতো যেন হাড়গোড় গুঁড়িয়ে দিতে লাগল–আছড়ে আছড়ে ফেলতে লাগল এক-একদিকে–সেই সঙ্গে পিঠের ওপর চলল গাঁইতি ঠোঁটের ধারালো ঠোক্কর। কোনওমতে ঠিকরে গিয়ে পড়েছিলাম ল্যাগুনের জলে– গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে পড়েছিলাম। হারামজাদা বেল্লিকের বাচ্চা জলে নামবে না জানি গা ভিজে যাবে যে! সে কী ঝাঁপাই। চিৎকারটা অনেকটা ময়ূরের ডাকের মতো, তবে সাংঘাতিক চড়া। সহ্য করা যায় না। ঝুঁটি উঁচিয়ে শুরু হল পায়চারি বালির ওপর, যেন নবাবপুত্তুর। না বলেও পারছি না, খানদানি টহল দেখে নিজেকে বড় ছোট মনে হয়েছিল। ওরকম লর্ড স্টাইলে হাঁটা আমার দ্বারা জীবনে হবে না। দেখছি আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। সারা শরীর থেঁতলে দিয়েছে শয়তানের বাচ্চা, দরদর করে রক্ত পড়ছে মুখের এই কাটা থেকে।
কাটাছেঁড়া থেঁতলানির যন্ত্রণাকেও ছাপিয়ে উঠল মনের যন্ত্রণা। ডিম ফুটিয়ে যাকে জন্ম দিলাম, খাইয়েদাইয়ে এতটা বড় করলাম, তার কাছে এইরকম নেমকহারামি আশা করতে পারিনি। বেটাছেলের মেজাজ ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত কোথাও ঘাপটি মেরে বসে থাকা দরকার বুঝলাম। সাঁতরে গেলাম একটা লম্বা তাল গাছের তলায়। ডগায় উঠে বসে রইলাম চোরের মতো। ভাবুন তখন আমার মনের অবস্থাটা! একটা বেইমানের ভয়ে জুজু হয়ে বসে রয়েছি বিজন দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু গাছের ডগায়! মানুষের বাচ্চা আমি। চারশো বছর আগে লোপ পেয়ে-যাওয়া একটা পাখির বাচ্চার ভয়ে কাঁপছি ঠকঠক করে।