ফসফরাসের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। চুপিসারে গেলাম কাছে। ভেবেছিলাম, ছুরি চালানোর দরকার হবে। কিন্তু হাত গন্ধ করতে হল না। মুখ গুজরে যে বেটা খোলে লটকে পড়েছিল –আমার গুলিতেই তার প্রাণটা বেরিয়ে গেছে। লাশটা ফেলে দিলাম জলে।
খানকয়েক বিস্কুট আর জল খেয়ে একটু ঝিমুনি এসেছিল। ভোর হল, ডাঙার চিহ্ন কোনওদিকে দেখলাম না। দূরে একটা পালতোলা জাহাজের মাস্তুলের ডগাটুকুই কেবল দেখা গেল–দূরেই তা মিলিয়ে গেল। মাথার ওপর সূর্য আসতেই চড়া রোদে প্রাণ যায় আর কী। বিস্কুট মোড়া ছিল একটা খবরের কাগজে। জীবনে কাগজ পড়ি না মশায়। জঘন্য! সেদিন কিন্তু কাজে দিল কাগজখানা। মাথায় ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। বার কুড়ি পড়েও ফেললাম। তা সত্ত্বেও ফোঁসকা পড়ে গেল সারা গায়ে।
দিন দশেক কষ্ট সয়েছি এইভাবে। কী মারাত্মক রোদ! চোখ মেলে তাকাতেও পারিনি। ভোরবেলা আর বিকেলবেলা দেখতাম, জাহাজ-টাহাজ দেখা যায় কি না। দেখেওছিলাম– দুবার। গলাবাজি করেও কাউকে কাছে আনতে পারিনি। দ্বিতীয় দিন একটা ডিম ভেঙে খাওয়া আরম্ভ করেছিলাম। একটু গন্ধ থাকলেও খারাপ নয়। অনেকটা হাঁসের ডিমের মতো। হলদে কুসুমের একপাশে ইঞ্চি ছয়েক লম্বা এক ধ্যাবড়া দাগ দেখেছিলাম। সরু সরু সুতোর মতো রক্ত আর মইয়ের মতো কী যেন ছিল তাতে–অদ্ভুত। মানে বুঝতে পারিনি তখন–পরে পেরেছিলাম। তিন দিন ধরে খেয়েছিলাম ওই একখানা ডিম–বিস্কুট আর জলের সঙ্গে। আট দিনের দিন আর-একখানা ডিম ভাঙবার পর খাড়া হয়ে গেল গায়ের লোম। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। ডিম ফুটছিল একটু একটু করে। বিশ্বাস করা যায় না। আমার কিন্তু হয়েছিল। চোখের সামনে দেখে বিশ্বাস না করে পারা যায়? তা ধরুন শতিনেক বছর কালো কনকনে কাদায় পোঁতা ছিল ডিমখানা–একদম নষ্ট হয়নি–এখন বাচ্চা তৈরি হচ্ছে রোদের তাতে। জ্বণই তো বলে?–জ্বণের মধ্যে বিরাট মাথা আর বাঁকা পিঠ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, গলার নিচে হৃৎপিণ্ড ধুকধুক করছে, কুসুম শুকিয়ে আসছে, মস্ত পাতলা পরদা খোলার ভিতরে ছড়িয়ে পড়ছে, কুসুম ঢেকে ফেলছে। কী কাণ্ড বলুন তো! ভারত মহাসাগরের ঠিক মধ্যিখানে ডিমে তা দিচ্ছি! পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখি যারা ছিল, তাদেরই একজনের ডিম–কোনকালে লোপ পেয়েছে, কিন্তু ডিম ফুটে বাচ্চা বেরচ্ছে আমার সামনে! ডসন যদি জানত, চার বছরের মাইনে এককথাতে বার করে দিত! তা-ই না?
তা-ই বলে খেতেও ছাড়িনি। আধফোঁটা বাচ্চাকেই খেয়েছি একটু একটু করে। বিতিকিচ্ছিরি খেতে। তৃতীয় ডিমটাকে আর ভাঙিনি। রোদ্দুরের সামনে তুলে ধরেছিলাম। খোলার মধ্যে দিয়ে কিছু দেখতে পাইনি। তবে রক্তচলাচলের শব্দ যেন শুনতে পেয়েছিলাম। কানের ভুলও হতে পারে।
তারপর পেছোলাম অ্যাটলে। চাকার মতো প্রবালদ্বীপ-মাঝখানে উপহ্রদ। তখন সূর্য উঠেছে অ্যাটলের সামনে। আধ মাইল পথ হাতে করে দাঁড় টেনেছিলাম, কখনও ডিমের ভাঙা খোলা দিয়ে। স্রোতের টান নৌকোকে অন্যদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। মরিয়া হয়ে জল কেটে নৌকো নিয়ে গেলাম তীরে। মামুলি অ্যাটল। ডাঙায় নেমে দেখলাম গোটাকয়েক গাছ, একপাশে একটা ঝরনা, হ্রদ বোঝাই কাকাতুয়া-মাছ। একপাক ঘুরে এলাম, মোটে মাইল চারেক। ডিমটাকে ডাঙায় রাখলাম রোদের তাতে বালির ওপর, জল সেখানে পৌঁছায় না। নৌকোটাকে টেনে তুলে রেখেছিলাম আগেই। তারপর শুরু হল রবিনসন ক্রুসোর জীবন। ছেলেবেলায় ভাবতাম খাসা জীবন। এখন দেখলাম জঘন্য। একঘেয়ে। খাবার খুঁজতে খুঁজতেই গেল প্রথম দিনটা। দিনের শেষে ঝড় উঠল, বৃষ্টি নামল রাতে।
ঘুমাচ্ছিলাম ক্যানোর তলায়। কপাল ভালো, ডিমটা ছিল অনেক উঁচুতে, বালির ওপর। হঠাৎ একটা ভয়ানক শব্দ শুনলাম। যেন একশো নুড়িপাথর আছড়ে পড়ল ক্যানোর গায়ে। ঢেউ চলে গেল মাথার ওপর দিয়ে। স্বপ্ন দেখছিলাম। আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় অন্ধকারে হাতড়েছিলাম চেয়ার আর দেশলাই। তারপরেই খেয়াল হল, আছি কোথায়। ফসফরাস জ্বলা ঢেউ যেন গিলে খেতে আসছে। আলো আর কোথাও নেই, আকাশ কালোকালির মতো রাত। বাতাস চেঁচিয়ে যাচ্ছে গলা ফাটিয়ে। মেঘ ঝুলে পড়েছে, মাথায় ঠেকে আর কী। বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে, আকাশ যেন ফুটো হয়ে গেছে। আগুন সাপের মতো কিলবিল করে বিরাট একটা ঢেউ তেড়ে এল আমাকে পেটে পুরতে। ভোঁ দৌড় দিলাম তক্ষুনি। ঢেউ যখন নেমে যাচ্ছে ফোঁস ফোঁস করে, ফিরে এলাম ক্যানোর কাছে। কিন্তু কোথায় ক্যানো? ডিমটাকে কিন্তু ঢেউ ধরতে পারেনি। ওই ডিমের পাশেই গুটিসুটি মেরে বসে কাটিয়ে দিলাম রাত। সে কী রাত! এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, এই দেখুন।
ভোর হল। ঝড় থামল। বালির ওপর নৌকোর কঙ্কালটাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখলাম। কুড়িয়ে আনলাম তক্তাগুলো। দুটো লাগোয়া গাছের ওপর পেতে বানিয়ে নিলাম ছাউনি। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরল সেইদিনই।
আমি তখন ঘুমিয়ে কাদা ডিমটাকেই মাথার বালিশ করে। হঠাৎ খটাং করে একটা আওয়াজে চটকা ভাঙল। ঝাঁকুনি লাগতেই ধড়মড় করে উঠে বসেছিলাম। দেখি কী, খোলা ফুটো হয়ে গেছে। ফাঁক দিয়ে একটা কদাকার বাদামি মুন্ডু আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। খাতির করে ডেকেছিলাম, এসো বাবা এসো, দুদু দেব, মাছ দেব, টুকুটুকু এসো। শুনেই খুটুর খুটুর করে সে বেরিয়ে এল বাইরে।