মাথা নুইয়ে সবিনয়ে অভিবাদন জানিয়ে ষণ্ডা বুচার বললে, খুবই মজার মামলা, তা ই না? চার-চারটে বছর দ্বীপে আটক ছিলাম, চাকরি থেকে জবাব দিতেও পারেনি। বছর বছর মাইনের টাকা জমা হয়েছে, দ্বীপে বসে আমি তার হিসেব রেখেছি।
ইন্টারেস্টিং।
খুবই। ইপাইওনিস নামটা নিশ্চয় শুনেছেন?
একটু একটু। মাসখানেক আগে অ্যান্ড্রুজ বলছিল। গবেষণা করছে একটা প্রজাতি নিয়ে, শোনার পরেই পাড়ি দিয়েছিলাম সমুদ্রে। একখানা মাত্র ঊরুর হাড় নিয়ে কেন যে এত পাগলামি।
ঊরুর হাড়?
হ্যাঁ। গজখানেক লম্বা। যার হাড়, সে নাকি দৈত্য বললেই চলে।
দৈত্য তো বটেই। সিন্দবাদের কিংবদন্তি এদের নিয়েই লেখা হয়েছে। কবে পেয়েছিল হাড়খানা?
বছর তিন-চার আগে। একানব্বইতে। কেন বলুন তো?
কেন মানে? ও হাড় তো আমিই আবিষ্কার করেছিলাম, বিশ বছর আগে। মাইনে নিয়ে ডসন কাদা ছোঁড়াছুড়ি না করলে ওই একখানা হাড়ের দৌলতেই মাতব্বর হয়ে যেতে পারত।
পেলেন কী করে?
হঠাৎ। নৌকোটা যে অমনভাবে নিজের খেয়ালে ঠিক ওই দ্বীপটাতে ভাসতে ভাসতে গিয়ে ঠেকবে, তা তো জানতাম না। আস্তানানারিভো থেকে প্রায় নব্বই মাইল উত্তরে সে বিরাট একটা জলাভূমি।
অ্যান্ড্রুজ তো বলছিল, জলা জায়গায় পাওয়া গেছে হাড়খানা।
পূর্ব উপকূলে আছে জায়গাটা। আপনার চোখে পড়েনি। জলের গুণেই হোক কি যে কারণেই হোক, পচন ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে না। গন্ধটা অনেকটা আলকাতরার মতো। ত্রিনিদাদের কথা মনে পড়ে যায়। ডিম পেয়েছিল আপনার বন্ধুরা? আমি পেয়েছিলাম। লম্বায় দেড় ফুটের মতো। গোল হয়ে ঘুরে গিয়ে জলাভূমি ঘিরে রেখেছে পুরো তল্লাটটাকে। বেশির ভাগই নুন। কপালজোরে পেয়ে গিয়েছিলাম ডিমগুলো। গিয়েছিলাম অবশ্য ডিম খুঁজতেই; দুজন কালা আদমি ছিল সঙ্গে। খানকয়েক ক্যানো নৌকো একসঙ্গে পাশাপাশি বেঁধে নিয়েছিলাম। তাঁবু ছিল সঙ্গে। ছিল চার দিনের খাবারদাবার। জমি যেখানে মোটামুটি শক্ত, কাদা কম, তাঁবু পেতেছিলাম সেখানে। সে কী গন্ধ মশায়! এখনও নাকে লেগে রয়েছে। দিনরাত ওই আলকাতরার গন্ধ সইতে হয়েছে। কাজটা কিন্তু মজার। লোহার শিক নিয়ে কাদা খোঁচানো, বাস! ওভাবে খোঁচাখুঁচি করলে ডিম কি কখনও ব্যস্ত থাকে? ডিম ফুটে কবে তারা শেষবারের মতো দাপিয়ে বেড়িয়েছিল দ্বীপময়, কালা আদমিদের কিংবদন্তি থেকে নাকি তা জানা যায়। কথাটা মিশনারিদের। আমি কিন্তু মশাই কোনও গল্পই শুনিনি। জীবন্ত ইপাইওরনিস কোনও ইউরোপীয়ের চোখে পড়েনি আজও। ১৭৪৫ সালে ম্যাকার নাকি মাদাগাসকার গিয়ে দেখেছিলেন। কিন্তু তা বিশ্বাস করতে মন চায় না। আমি কিন্তু তাজা ডিম পেয়েছিলাম। যেন সদ্য-পাড়া। এক্কেবারে টাটকা! নৌকোয় বয়ে আনতে গিয়ে পাথরে পড়েই মাস করে চৌচির একখানা। কী মিষ্টি গন্ধ মশায়, টাটকা ডিমে যেমন হয়। বাসি হলে পচা গন্ধ বেরত। অথচ ধরুন ডিম বেরিয়েছে যার পেট থেকে, সে অক্কা পেয়েছে চারশো বছর আগে। সারাদিন গেল কাদা ঘেঁটে ডিম বার করতে। মেজাজ খিঁচড়ে তো যাবেই। তবে হ্যাঁ, ডিমের মতো ডিম পেয়েছিলাম বটে। পরে লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে গিয়ে দেখেছিলাম খানকয়েক ডিম। চটা-ওঠা, খোলা-ভাঙা, ফুটিফাটা। আমার ডিমের মতো নয়, চিড় পর্যন্ত খায়নি খোলায়।
এই পর্যন্ত বলে মাটির পাইপ বার করেছিল বুচার। তামাকের থলি রেখেছিলাম সামনে। অন্যমনস্কভাবে পাইপে তামাক ভরতে ভরতে সে বলেছিল, মোট তিনটে আস্ত ডিম পেয়েছিলাম। বিলকুল তাজা, নৌকোয় রেখে ডাঙায় নেমেছিলাম তাঁবুতে বসে এক মগ কফি বানিয়ে খাব বলল। ভুল করেছিলাম সেইখানেই।
কেন?
যে কালা আদমিটার হাত ফসকে আস্ত একখানা ডিম পড়ে ফুটিফাটা হয়েছিল, তাকে পিটিয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছিলাম রাগের মাথায়। রাগলে আমি চণ্ডাল, কী করি বলুন। তা-ই বলে শোধ নেবে ওইভাবে? ভাবতেও পারিনি। কেটলিতে জল ফুটছে, মজাসে পাইপ টানছি–দুচোখ ভরে দেখছি জলাভূমির ওপর সূর্যাস্ত। সে এক খাসা দৃশ্য মশায়। সামনে লাল আকাশ, ধূসর পাহাড়, পেছনে কালো কাদা। মনে মনে হিসেব করছি, নৌকোয় আছে তিন দিনের মতো খাবার আর এক পিপে জল। ভয়ের কিছু নেই। এমন সময়ে একটা শব্দ কানে ভেসে এল। চোখ ফিরিয়ে দেখি, নৌকো নিয়ে হারামজাদারা সরে গেছে ডাঙা থেকে। বিশ গজ দূরে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম মতলব কী শয়তানের বাচ্চাদের। বন্দুক একটা আছে বটে তাঁবুতে–কিন্তু বুলেট নেই–পাখি-মারা ছররা আছে। হারামজাদারা তা জানে। তবে একটা ছোট রিভলভার ছিল পকেটে। টেনে বের করে দৌড়ালাম সমুদ্রের ধারে। তুলে ধরে হেঁকে বললাম ফিরে আসতে। কিন্তু কাজ হল না। উলটে সে কী টিটকিরি মশায়! হাড় জ্বলে গেল আমার। দিলাম দমাদম গুলি চালিয়ে। নৌকো তখন পঞ্চাশ গজ দূরে। কিন্তু এক বেটাকে ফেলে দিলাম জলে। আর-একটা মুখ গুঁজরে শুয়ে পড়ল খোলে। দাঁড়টাও ভেসে গেল জলে।
গলাবাজি করে কোনও লাভ নেই জেনে, জামাকাপড় খুলে, দাঁতে ছুরিখানা কামড়ে নিয়ে লাফ দিলাম জলে। সাঁতরে উঠব নৌকোয়–নৌকো যদিও ততক্ষণে বেশ দূরে। জলে হাঙর আছে জানি–সেই ভয়ে তো এই বিজন দ্বীপে একলা পড়ে থাকতে পারি না। যে নৌকোয় দাঁড় নেই, তা স্রোতের টানে কোনদিকে ভেসে যাবে, আঁচ করে নিয়ে সাঁতরে চললাম সেইদিকেই। নৌকো অবশ্য তখন দেখা যাচ্ছে না। দেখতে দেখতে রাত ঘনিয়েও এল, কালো কালির মতো অন্ধকারে ঢেউয়ের ডগায় সে কী ফসফরাসের আলো। চোখ ধাঁধিয়ে যায়! মাথার ওপর তেমনি তারার আলো। একটু পরেই দেখলাম কালো জমাট ছায়া। নৌকো। তলায় ঢেউ আছড়ে পড়ছে–