আস্তে আস্তে বিদঘুটে হয়ে উঠছিল মেঘের আকার। তলার দিকে যেন ঠেলে বেরিয়ে রয়েছে চারটে বস্তুপুঞ্জ–ওপরদিকে কী যেন একটা উঠে গেছে সিধে সরলরেখায়। অপচ্ছায়ার মতো এ আবার কী জিনিস? এ জিনিস দেখছি আগে… হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখেছি… কিন্তু কোথায় যে দেখেছি, কিছুতেই খেয়াল করতে পারলাম না। আচমকা উপলব্ধি করলাম বিচিত্র আকৃতির স্বরূপ। মুঠো-করা একটা হাত! মহাশূন্যে আমি একা, সামনে ওই প্রকাণ্ড ছায়াসম হাত, বস্তুময় গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক কণা অকিঞ্চিৎকর ধুলোর মতো পড়ে রয়েছে ওই হাতের নিচে। তর্জনীতে ঝকঝক করছে একটা আংটি। আংটির কিনারায় চিকমিক করছে এক কণা অলো–যে ব্রহ্মাণ্ড ছেড়ে এলাম–ওই ব্রহ্মাণ্ড। মুঠোয় ধরা বস্তুটাকে দেখতে অনেকটা কালো ডান্ডার মতো। অনন্তকাল ধরে ভয়ে-বিস্ময়ে অসহায়ভাবে চেয়ে ছিলাম সেই হাত আর সেই ডান্ডার দিকে–কী যে ঘটবে এরপর, বুঝতে পারিনি। কেবলই মনে হচ্ছিল, ঘটবে না কিছুই, চেয়ে থাকতে হবে অনন্তকাল ধরে এইভাবে কোনওদিনই বুঝব না ওই হাত আর ওই ডান্ডার তাৎপর্য, কেন ওই উপস্থাপন, কীসের ছায়া। আমার সত্তাহীন নৈর্ব্যক্তিক সত্তায় থেকে যাবে শুধু যা অমোঘ, যা আদি এবং অন্তহীন–তারই উপস্থিতি। বৃহত্তর অন্য কোনও সত্তার ওপরে এই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা প্রতিসরিত আলোককণা কি না, এ প্রশ্নের জবাবও পাব না কোনওদিন। কোনওদিনই জানব না এই রবি-শশী-তারাভরা বিশাল ব্ৰহ্মাণ্ড আরেকটা ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণুমাত্র কি না, সেই ব্রহ্মাণ্ডটাও হয়তো আরেকটা ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণু। এবং সে ব্রহ্মাণ্ডও আরেক ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণু ছাড়া কিছুই নয়। এইভাবেই কি চলছে সৃষ্টির পরম্পরা? কে জবাব দেবে এই প্রহেলিকার? আমিই বা কী? বাস্তবিকই কি অ-বস্তু? আমার চারদিকে একটা দেহ দানা বেঁধে উঠছে যেন মনে হল–খুবই আবছা উপলব্ধি। নারকীয় তমিস্রার মধ্যে ওই হাত যে ইঙ্গিত বহন। করছে, নিশ্চিতভাবে তা বুঝলাম না। হৃদয়ভাব দিয়ে শুধু টের পেলাম, নিরাকারের মধ্যে থেকে অনেক আকার তৈরি হয়ে যাচ্ছে… কাঁপছে… দুলছে… আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।
ঘণ্টাধ্বনির মতো একটা শব্দ শুনলাম। ক্ষীণ শব্দ। যেন অসীমের ওপার থেকে ভেসে আসা শব্দ–নিরেট তমিস্রা ফুঁড়ে আসতে হচ্ছে বলে, এত অস্পষ্ট। আবার… আবার সেই ঘণ্টাধ্বনি… অনুধ্বনিত হচ্ছে সুগম্ভীর শব্দে… অনুকম্পন আর অনুরণন কাঁপছে একটি ঘণ্টাধ্বনি থেকে আরেকটি ঘণ্টাধ্বনির অন্তর্বর্তী সময়ে। সেই সঙ্গে মনে হল যেন শক্তভাবে ডান্ডা চেপে ধরল হাতটা। হাতের অনেক ঊর্ধ্বে, অন্ধকারের মধ্যবিন্দুতে দেখলাম একটা আলোকবৃত্ত–অস্পষ্ট ফসফরাস-দ্যুতির মতো। ভৌতিক বর্তুলের মতো আলোক-গোলকের মধ্যে ধুক ধুক করে শব্দনাদ সৃষ্টি করে চলেছে ঘণ্টাধ্বনি। শেষ ধ্বনিটার সঙ্গে সঙ্গেই অদৃশ্য হয়ে গেল হাতখানা। বুঝলাম, সময় হয়েছে নিকট। শুনলাম বিপুল জলোচ্ছাসের গুরুগম্ভীর দূরায়ত গর্জন। মহাকাশের বুকে বিশাল পটির মতো কিন্তু স্থির হয়ে রইল কালো ডান্ডাটা। তারপরেই মহাশূন্যের দূরতম প্রান্ত পর্যন্ত ধেয়ে গেল একটা কণ্ঠস্বর অবসান ঘটল যন্ত্রণার।
তৎক্ষণাৎ অসহ্য হর্ষ-উল্লাসের আবর্তে মুহ্যমান হয়ে গেলাম। দেখলাম, উজ্জ্বল হয়ে উঠছে চকচকে সাদা বৃত্তটা, চেকনাই ছড়াচ্ছে কালো ডান্ডাটা, স্পষ্ট পরিষ্কার হয়ে উঠছে আরও অনেক কিছু। বৃত্তটা হয়ে গেল ঘড়ির ডায়াল, ডান্ডাটা আমার খাটের রেলিং। হ্যাডনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আমার পায়ের দিকে রেলিং-এর পাশে–হাতে একটা ছোট কাঁচি। ঘাড়ের ওপর দিয়ে ম্যান্টেলে রাখা ঘড়ির ডায়ালে দেখা যাচ্ছে, কাঁটা দুটো এক হয়ে গিয়ে খাড়া হয়ে রয়েছে বারোটার ঘরে। আটকোনা টেবিলে কী যেন ধুচ্ছে। মোত্রে, পাঁজরে অনুভব করলাম একটা চাপা অনুভূতি–যাকে যন্ত্রণা বলা যায় না কোনওমতেই।
সাঙ্গ হয়েছে অপারেশন। আমি মরিনি। আচম্বিতে উপলব্ধি করলাম, আধখানা বছর জুড়ে থাকা চাপা বিষাদবোধও তিরোহিত হয়েছে মনের ভেতর থেকে।
ইপাইওরনিস আইল্যান্ড রহস্য
ইপাইওরনিস আইল্যান্ড রহস্য (Epyornis Island)
[‘ÆpyornisIsland’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায়। ১৯০৫ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘Pearsons Magazine’ পত্রিকায়। ১৮৯৫ সালে লন্ডনের ‘Methuen & Co.’ থেকে প্রকাশিত ওয়েলসের প্রথম ছোটগল্পের সংকলন ‘The Stolen Bacillus and Other Incidents’-তে গল্পটি স্থান পায়।]
একে তো ওই ষণ্ডা চেহারা, তার ওপর চোয়াড়ে মুখজোড়া বিরাট কাটার দাগ। দেখলেই গা শিরশির করে।
টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে আমার পুঁটলির দিকে তাকিয়ে সে বললে, অর্কিড চারা মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ।
সাইপ্রিপেডিয়াম নিশ্চয়?
বেশির ভাগ তা-ই।
নতুন কিছুই পাননি। পঁচিশ… না, না, সাতাশ বছর আগে ও দ্বীপের সব দেখে এসেছি। কতই বা বয়স তখন। উড়ে উড়ে বেরিয়েছি। কাঁচা বয়সে যা হয় আর কী। দুবছর ছিলাম ইস্ট ইন্ডিজে, ব্রাজিলে সাত বছর। তারপর গেলাম মাদাগাসকারে।
জনাকয়েক অভিযাত্রীর নাম আমার জানা আছে। কার চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন?
ডসন-এর। বুচার নামটা জানা আছে?
বুচার? খুবই চেনা-চেনা মনে হল নামটা। তারপরেই মনে পড়ে গেল বুচার বনাম ডসন মোকদ্দমা-কাহিনি–আচ্ছা! আপনিই তাহলে বুচার! চার বছরের মাইনে আদায় করেছিলেন মামলা ঠুকে দিয়ে। চার বছর মরুদ্বীপে পরিত্যক্ত থাকার মাইনে–