এরপরেই উপলব্ধি করলাম, মন মন্থরগতি হয়েছে, ধারণা নতুন রূপ নিচ্ছে, মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে আবর্তন দেখলাম, এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তার মধ্যেকার সময়ের ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে–এক-এক মুহূর্তে এক-একটা হাজার বছর অতিবাহিত হচ্ছে।
অনন্ত মহাশূন্যের কালো পটভূমিকায় এতক্ষণ নিশ্চল ছিল নক্ষত্রমণ্ডলী। হঠাৎ তাদেরকেও সরে যেতে দেখলাম। ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে দুর হতে দুরে। আচমকা অন্ধকারের মধ্যে থেকে সূর্যকরোজ্জ্বল একঝাঁক প্রস্তরখণ্ড ধূলিকণার মতো আলোকময় প্রভায় চারদিক উজ্জ্বল করে দিয়ে বেরিয়ে গেল আশপাশ দিয়ে। মিলিয়ে গেল দুরে। তারপরেই দেখলাম, একটা উজ্জ্বল আলোর কণা দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠল আলোটা। শনি গ্রহ। আকার বেড়েই চলেছে পলকে পলকে। মুহূর্তে মুহূর্তে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পেছনের মহাকাশ আর অগুনতি নক্ষত্র। চ্যাপটা, ঘুরন্ত গ্রহের চারদিকে থালার মতো বলয় আর সাতটা উপগ্রহকে স্পষ্ট লক্ষ করা যাচ্ছে। নিমেষে বিশাল হতে বিশালতর হয়ে যেন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল অতিকায় শনি গ্রহ, ধেয়ে চললাম অগুনতি পাথরের ধারাবর্ষণের মধ্যে দিয়ে… পাথরে পাথরে সে কী সংঘাত। ধূলিকণার তাণ্ডবনৃত্য আর গ্যাস-আবর্তের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চকিতের জন্যে দেখলাম মাথার ওপর প্রকাণ্ড তিনটে বেল্ট; একই কেন্দ্র ঘিরে যেন তিনটে চন্দ্রালোকিত খিলেন। ছায়া পড়েছে নিচের ফুটন্ত প্রলয়কাণ্ডের ওপর। বলতে যতটা সময় গেল, তার এক দশমাংশ সময়ের মধ্যেই ঘটে গেল এত কাণ্ড। বিদ্যুঝলকের মতো উধাও হয়ে গেল শনি গ্রহ। সূর্যকে ঢেকে রাখল কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। তারপরেই দেখা গেল আলোর পটভূমিকায় পাক খেতে খেতে মিলিয়ে যাচ্ছে একটা ধ্যাবড়া কালচে দাগ। ধরিত্রী মা-কে। আর দেখতে পেলাম না।
রাজকীয় গতিবেগে, অখণ্ড নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে এলাম সৌরজগৎ। যেন একটা জামা খুলে পড়ে গেল গা থেকে। অগণিত তারকারাজির মধ্যে নিছক একটা নক্ষত্র হয়ে জেগে রইল সূর্য-আশপাশে ধূলিকণার মতো গ্রহ–বহু দূরের আলোয় স্পষ্ট নয় কোনওটাই মিলেমিশে একাকার। সৌরজগতের বাসিন্দা আর নই আমি। এসে পড়েছি বাইরের ব্রহ্মাণ্ডে–বহিঃমহাকাশে। আরও দ্রুত ঘনীভূত হল কয়েকটা নক্ষত্রমণ্ডলী–চেনা তারকামণ্ডলীরা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর। ঘুরন্ত নীহারিকার মতো দেখতে হল মহাকাশের সেইদিকটা। তার ওপারে ব্যাদিত মহাশূন্যতা–খণ্ড খণ্ড নিঃসীম তমিস্রা–মাঝে মাঝে চিকমিক করছে নক্ষত্র। কমে আসছে সংখ্যায়। মনে হল যেন দ্রুত হতে দ্রুততর হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ডের ছুটে যাওয়া–ধূলিকণার আকারে নিঃশব্দে বিলীন হচ্ছে মহাশূন্যে। ঝকঝকে নক্ষত্ররা আরও ঝকঝকে হয়ে উঠছে, কাছাকাছি এসে দেখছি, গ্রহদের গা থেকে ঠিকরে যাচ্ছে যেন ভৌতিক দ্যুতি। পরমুহূর্তেই দপ করে নিবে যাচ্ছে ভূতুড়ে আলো–মিলিয়ে যাচ্ছে অনস্তিত্বের মধ্যে। অস্পষ্ট ধূমকেতু, উল্কার ঝাঁক, বস্তুকণা, আলোককণার ঘূর্ণি সাঁত সাঁত করে বেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। কেউ কোটি কোটি মাইল দূর দিয়ে, কেউ কাছ দিয়ে। অকল্পনীয় গতিবেগ প্রত্যেকেরই। ধাবমান তারকামণ্ডলী, ক্ষণিক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ কুচকুচে কালো প্রকাণ্ড রাত্রির বুক ভেদ করে ছুটে এসেই মিলিয়ে যাচ্ছে নিমেষে নিমেষে। বিশাল হতে বিশালতর হচ্ছে নক্ষত্রহীন দুরের মহাশূন্য–যেদিকে আকৃষ্ট হয়ে চলেছি আমি বিরামবিহীনভাবে। দেখতে দেখতে মসিকৃষ্ণ এবং বেবাক শূন্য হয়ে গেল মহাকাশের সিকি অঞ্চল–দ্যুতিময় নক্ষত্রময় ব্রহ্মাণ্ড পেছনে ছুটে গিয়ে কাছাকাছি হতে হতে আলোকপুঞ্জ হয়ে গেল। এসে পড়লাম ধু ধু মহাশূন্যতার মধ্যে। কালো অমানিশা আস্তে আস্তে বিরাটতর হয়ে চারদিক থেকে ছেকে ধরল আমাকে–আগুনের কণার মতো নক্ষত্রগুলো ঝটিতি সরে গেল দূর হতে দূরে–নাস্তি আর শূন্যতার গহ্বরে একা আমি ধেয়ে চললাম কোথায় কে জানো বস্তু দিয়ে গড়া অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডও শেষকালে এক কণা আলোকময় ধুলোর মতো অস্পষ্ট হয়ে এল পেছনে–একেবারেই অদৃশ্য হতে আর দেরি নেই।
আচম্বিতে মহা-আতঙ্ক পেয়ে বসল আমাকে। ভাষা দিয়ে সেই আতঙ্ক অনুভূতিকে প্রকাশ করা যায় না। সীমাহীন এই অন্ধকারের মধ্যে আমার মতোই কি রয়েছে আরও অনেক অদৃশ্য আত্মা? পৃথিবীর সমাজবদ্ধ জীব আমি–আত্মাদের সমাজ কি পাব এখানেনা, একাই থাকতে হবে? কী অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছি, তা-ও তো বুঝছি না। জীবসত্তা থেকে বেরিয়ে এসে সত্তা আর সত্তাহীনতার মাঝামাঝি পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম নাকি? দেহের খোলস, বস্তুর খোলস সবই টেনে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে আমার কাছ থেকে সঙ্গ আর নিরাপত্তা এখন নিছক মরীচিকা। চারদিকেই তো নিবিড় তমিস্রা–অখণ্ড নীরবতা। সত্তা ছিল –এখন নেই। কিছুই নই এখন আমি। নিতল গহ্বরে নিরতিশয় ক্ষুদ্র এক কণা আলো ছাড়া কিছুই তো আর দেখা যাচ্ছে না। প্রাণপণে শোনার, দেখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অসীম নৈঃশব্দ্য, অসহ্য অন্ধকার, বিভীষিকা আর নৈরাশ্য ছাড়া কিছুই উপলব্ধি করিনি।
ব্রহ্মাণ্ডের সব বস্তু যেখানে জড়ো হয়েছে, সেইখানে হঠাৎ দেখলাম একটা ক্ষীণ দ্যুতি। দ্যুতির দুপাশের পটিও নিঃসীম তমিস্রায় আবৃত নয়। যেন অনন্তকাল ধরে চেয়ে ছিলাম সেইদিকে। দীর্ঘক্ষণ প্রতীক্ষার পর ঝাপসা দ্যুতি স্পষ্টতর হল বটে, কিন্তু বোধগম্য হল না কিছুই। তারপরেই পটির চারদিকে আবির্ভূত হল অতিশয় ক্ষীণ, অতিশয় ম্যাড়মেড়ে বাদামি রঙের মেঘ। অসহ্য অসহিষ্ণুতায় অস্থির হয়েছিলাম। কিন্তু এত ধীরগতিতে মেঘটার ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে, কিছুতেই আন্দাজ করতে পারলাম না কী ধরনের বিস্ময়ের সম্মুখীন হতে চলেছি। মহাশূন্যের চিররাত্রির মধ্যে ওই অদ্ভুত লালাভ উষা কীসের সূচনা বহন করছে, কিছুতেই বুঝে উঠলাম না।