দেখলাম, শূন্যে ভাসছি। শুধু ভাসছি নয়, প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে যাচ্ছি ওপরদিকে। অনেক নিচে দ্রুত ছোট হয়ে আসছে লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ড। ঊর্ধ্বগতি কিন্তু পশ্চিম-ঘেঁষা। পাতলা ধোঁয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম অসংখ্য ছাদের চিমনি, মানুষ আর যানবাহনে বোঝাই সরু সরু রাস্তা, ছোট্ট ছোট্ট ধূলিকণার মতো চৌকোনা পার্ক, আর কাপড়ের গায়ে বিঁধে থাকা কাঁটার মতো গির্জের চূড়া। অচিরেই তা সরে গেল দৃষ্টিপথ থেকে পৃথিবী ঘুরছে বলে। সে জায়গায় আবির্ভূত হল পাশের গ্রাম, শহরতলি, নদী। কোথায় যে চলেছি নক্ষত্রবেগে, কিছু বলতে পারলাম না।
পলকে পলকে নিচের নিসর্গদৃশ্য বিশাল হতে বিশালতর অঞ্চল জুড়ে জেগে উঠল চোখের সামনে, শহর আর প্রান্তর, পাহাড় আর উপত্যকা, আরও কুয়াশাচ্ছন্ন, আরও ম্যাড়মেড়ে, আরও অস্পষ্ট হয়ে এল, পাহাড়ের নীল বর্ণ আর মাঠ-ময়দানের সবুজ রঙের সঙ্গে আলোকময় ধূসরাভা আরও বেশি মিশে যেতে লাগল। নিচে অনেক পশ্চিমে ছোট ছোট মেঘের টুকরো আরও ঝকমকে সাদা হয়ে উঠতে লাগল। মাথার ওপর আকাশের রংও পালটে গেল একটু একটু করে। প্রথমে যা ছিল বসন্তের আকাশের মতো নীলিমায় নীল, আস্তে আস্তে তা গাঢ়তর হয়ে মধ্যরাতের আকাশের মতো কালো হয়ে গেল, তারপর হল তুষার-ঝরা নক্ষত্রলোকের মতো মিশমিশে কালো, তারপর যে মসিকৃষ্ণ রংটি উপস্থিত হল, সেরকম কালো রং কখনও দেখিনি। প্রথমে দেখা গেল একটা তারা, তারপর অনেক, তারপর ঝাঁকে ঝাঁকে–অগুনতি। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে এত নক্ষত্র একসঙ্গে কেউ কখনও দেখেনি। দিনের আলোয় তারা দেখা যায় না নীল গগনে। শীতের রাতেও দেখা যায় না। তারার আলো থাকে বলে। কিন্তু এখন আর চোখে ধাঁধা লাগছে না–রাশি রাশি তারার অদ্ভুত সমারোহ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মরলোকের কেউ এমন স্বর্গীয় দৃশ্য কখনও দেখেনি। অবিশ্বাস্যভাবে অদ্ভুত এবং আশ্চর্য হয়ে উঠেছে সূর্য। চোখধাঁধানো সাদা আলোয় গড়া সূর্য। পৃথিবী থেকে দেখায় হলদেটে। কিন্তু আমি দেখলাম ধবধবে সাদা সূর্য। লাল ডোরা রয়েছে সাদার ওপর। কিনারা ঘিরে লকলকে লোহিত অগ্নিজিহ্বা। দুপাশে পাখির ডানার মতো রুপোলি সাদা দুটো প্রত্যঙ্গ ঠিকরে গেছে মহাশূন্যের বহু দূর পর্যন্ত। ঠিক যেন ডানাওয়ালা গোলক। মিশরীয় ভাস্কর্যে দেখেছিলাম এই ধরনের ছবি। পার্থিব জীবনে সৌরচ্ছটার ছবি দেখেছিলাম–এখন দেখলাম স্বচক্ষে।
পৃথিবীর দিকে ফের তাকিয়ে দেখি, সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ সরে গেছে আরও দূরে। অনেক আগে থেকেই মাঠ-ময়দান-প্রান্তর পর্বতকে আলাদাভাবে চেনা যাচ্ছিল না। সব রং মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এখন যা দেখা যাচ্ছে তা একটা সমান উজ্জ্বল ধূসর রং। মাঝে মাঝে ঝকঝকে সাদা মেঘপিণ্ড। সমুদ্র ডাঙার চাইতে গাঢ় ধূসর রঙের। পুরো দৃশ্যটা আস্তে আস্তে ঘুরে যাচ্ছে পূর্বদিকে।
দ্রুত ঘটে চলেছে ঘটনাস্রোত। পৃথিবী থেকে হাজারখানেক মাইল সরে আসার আগে নিজের কথা মনেই হয়নি। উপলব্ধি করলাম একটা আশ্চর্য ব্যাপার। আমার হাত নেই, পা নেই, দেহাংশ নেই, দেহযন্ত্র নেই, ভয় নেই, যন্ত্রণা নেই। বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে এসেছি অনেকক্ষণ। চারপাশে শূন্যতা। মানুষের কল্পনাতীত। আমি কিন্তু নির্বিকার। নির্ভয়। সূর্যালোক ধেয়ে যাচ্ছে শূন্যতার মধ্যে দিয়ে। বস্তুতে প্রতিহত হচ্ছে না বলে আলো বা উত্তাপ দিচ্ছে না। নিবিড় প্রশান্তিময় বিস্মৃতিতে আছন্ন আমার সত্তা। যেন স্বয়ং ঈশ্বর আমি। সেকেন্ডে সেকেন্ডে অসংখ্য মাইল দূরে সরে যাচ্ছে বহু নিচে লন্ডন শহরের আমার ছোট্ট ঘরখানি–দুজন ডাক্তার আমার খোলসটাকে নিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছে আবার তার মধ্যে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু আমি যে মুক্তির স্বাদ, যে অনাবিল প্রশান্তি, যে অনির্বচনীয় পরিতৃপ্তি পেয়েছি, তার সঙ্গে মরজগতের কোনও আনন্দের তুলনা হয় না।
পলকের মধ্যে এতগুলো উপলব্ধির পর পৃথিবী ছেড়ে বেগে উধাও হওয়ার অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এত সহজ আর অবশ্যম্ভাবী ব্যাপারটা কেন যে আগে ভাবিনি, ভাবতে গিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি হঠাৎ–ভেসে যাচ্ছি শূন্যপথে। বস্তুজগতের সঙ্গে যেখানে এতটুকু বাঁধন ছিল, সব ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে সেকেন্ডে সেকেন্ডে প্রচণ্ড গতিবেগে ধেয়ে চলেছি আকাশভরা সব চন্দ্র-গ্রহ-নক্ষত্রর দিকে। মাধ্যাকর্ষণের আকর্ষণ অনুভব করছি না। বস্তুরহিত বলেই মহাশূন্যে এত আকর্ষণশূন্য। মাংস দিয়ে গড়া পিঞ্জর পড়ে তো পৃথিবীতে। পৃথিবীকে আমি ত্যাগ করছি না–পৃথিবীই আমাকে ত্যাগ করছে–গোটা সৌরজগৎটাই সাঁ সাঁ করে সরে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। চোখে দেখতে না পেলেও উপলব্ধি করছি, আমার মতোই মুক্তির আনন্দে বিহ্বল বহু আত্মা বিরাজমান আমার চতুর্দিকে। বস্তুপিঞ্জর থেকে মুক্তি পেয়ে, পাশবিক লোভ, নগ্ন বুদ্ধিমত্তা, অর্থহীন আবেগ-অনুভূতি থেকে ছাড়া পেয়ে আচম্বিতে উদবেল হয়ে উঠেছে প্রত্যেকেই। মহাশূন্য ভেদ করে ধেয়ে চলেছে তারা আমার পাশে পাশে–অদৃশ্য অবস্থায়!
পৃথিবী আর সূর্যের কাছ থেকে ক্রমশ দুরে সরে যেতে যেতে উপলব্ধি করলাম, অবিশ্বাস্যভাবে আকারে-আয়তনে বড় হয়ে যাচ্ছি যেন। মানুষের জীবনে বড় বলতে যা কল্পনা করা যায়, সেই তুলনায় অনেক… অনেক বড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পূর্ণিমার চাঁদের মতোই বৃহদাকার ধারণ করল পৃথিবী। মিনিটকয়েক আগে দ্বিপ্রহরের সূর্য প্রদীপ্ত রেখেছিল যেখানে ইংল্যান্ডে, এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে রোদ্দুর ঝকঝকে আমেরিকাকে। মুহূর্তে মুহূর্তে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে আসছে পৃথিবী গোলক। কিনারায় আবির্ভূত হল চন্দ্র। নক্ষত্রমণ্ডলী দেখে অবাক হলাম। চেনাজানা তার মালা ছাড়াও দেখলাম অনেক অজানা অচেনা নক্ষত্রমণ্ডলী। প্রশান্ত দ্যুতি সমুজ্জ্বল নক্ষত্ররাশিতে উদ্ভাসিত মহাশূন্য। পৃথিবী পলকের মধ্যে সূর্যের মতো ছোট হয়ে এল। বিপরীতদিকে আলপিনের ডগার মতো মঙ্গল গ্রহকে দেখা গেল। মহাজাগতিক ধূলিকণার মতো পৃথিবী মিলিয়ে যাচ্ছে বহু দূরে। আতঙ্ক বা বিস্ময়–কোনওটাতেই আচ্ছন্ন হলাম না।