হ্যাডন বলেছিল, মোটেই না। ক্লোরোফর্ম করা হবে তো। আমার হার্ট নাকি দারুণ মজবুত। নাকে ভেসে এসেছিল ঘুমপাড়ানি ওষুধের মিষ্টি গন্ধ।
পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিয়েই ক্লোরোফর্ম দিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। প্রথমে মনে হয়েছিল, দম আটকে আসছে। মরতে চলেছি তো জানি, এবার লোপ পাবে জ্ঞান। হঠাৎ মনে হল, সে কী! মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হইনি তো এখনও অনেক কর্তব্য যে এখনও বাকি। কী কর্তব্য তা অবশ্য জানি না, মনেও করতে পারলাম না, কী কাজ এখনও করা হয়নি। জীবনে কী কী আকাক্ষা এখনও অপূর্ণ রয়েছে, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। অথচ মরবার ইচ্ছেও হল না। শারীরিক অস্বস্তি যন্ত্রণার পর্যায়ে পৌঁছেছে–বেশ উপলব্ধি করলাম। ছটফট করেছিলাম। তারপর নিস্পন্দ হয়ে গেলাম। নৈঃশব্দ্য আর তমিস্রা গ্রাস করল আমাকে।
কত মিনিট কত সেকেন্ড জ্ঞান হারিয়েছিলাম, বলতে পারব না। হঠাৎ গা শিরশির-করা আবেগহীন অনুভূতির মধ্যে দিয়ে টের পেলাম, আমি মরিনি। দেহের খাঁচার মধ্যেই রয়েছি। কিন্তু যেন মুক্তি পেয়েছি। পুরোপুরি নয়। মাংসময় দেহে আটকে আছি ঠিকই, কিন্তু দেহটা যেন আর আমার নয়। কিছুই দেখিনি, কিছুই শুনিনি, তবুও যা যা ঘটেছে, তার সবই টের পেয়েছি–শোনা আর দেখার মতোই। হ্যাডন ঝুঁকে রয়েছে আমার ওপর, বিরাট একটা স্ক্যালপেল হাতে পাঁজরা কেটে ফালাফালা করছে মোব্রে। যন্ত্রণা নেই। মাংস কেটে যাচ্ছে টের পাচ্ছি কিন্তু ভালোই লাগছে। যেন দুজন দাবা খেলোয়াড়ের দান দেওয়া দেখছি মজা লাগছে। কৌতূহল নিবিড়। হ্যাডনের মুখ শক্ত, হাত অচঞ্চল। কিন্তু অপারেশন যে সাকসেসফুল হবে না–এইরকম একটা ধারণা রয়েছে মনের মধ্যে। কী করে ওর মনের কথা টের পেলাম, তা বলতে পারব না।
মোব্রে কী ভাবছে, তা-ও টের পেয়েছিলাম। ও ভাবছিল, বিশেষজ্ঞ হয়েও হ্যাডন এত মন্থরগতি কেন? কী কী করা উচিত, বলতে চাইছে, মাথার মধ্যে চিন্তাগুলো হাজার হাজার বুদবুদের মতো ঠেলে উঠছে। হ্যাডনের দক্ষ ক্ষিপ্র ছুরিচালনা দেখে মুগ্ধ হয়েছে, তা-ও টের পাচ্ছি ওর চেতনার বিস্ফোরণ অনুভব করে। হ্যাডনের দক্ষতা মোরে মাথার মধ্যে ঈর্ষার সঞ্চার ঘটাচ্ছে, তা-ও উপলব্ধি করছি। যকৃৎ খুলে বার করে নেওয়া দেখলাম। হতভম্ব হলাম নিজের অবস্থা দেখে। মরিনি। কিন্তু জীবিত সত্তা বলতে যা বোঝায়, তা-ও নই। বছরখানেক যে বিষণ্ণতায় ভুগেছি, আচম্বিতে তা উধাও হয়েছে। চিন্তা করছি, উপলব্ধি করছি কিন্তু আবেগের ছিটেফোঁটাও অনুভব করছি না। জানি না আর কেউ এভাবে ক্লোরোফর্মে জ্ঞান হারিয়ে সবকিছু টের পেয়েছে কি না, অন্যের মনের মধ্যে ঢুকতে পেরেছে কি না, তারপরেও সব মনে রাখতে পেরেছে কি না।
মরিনি এখনও বলতে পেরেও এইটুকু বুঝলাম, মরতে আর দেরি নেই। ঢুকলাম হ্যাডনের মনের মধ্যে। ভয় পাচ্ছে একটা মূল শিরার শাখা কাটতে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওর মানসিক দ্বন্দ্ব। গ্যালভানোমিটারের আয়নায় আলো কাঁপে যেভাবে থিরথির করে, ওর সজ্ঞান মনে তেমনি দুটো চিন্তার লড়াই চলছে। একটা আলো জোরালো হয়ে উঠছে। এই আলোয় দেখা যাচ্ছে ওর মনের ভাবনা–একটা কাটা শিরার ছবি। পরক্ষণেই জোরালো হয়ে উঠল আর-একটা আলোকময় চিন্তা-ভুল জায়গায় কাটা হয়েছে শিরা। ধস্তাধস্তি লেগে গেল দুটো আলোকময় সম্ভাবনাচিত্রে। প্রথমটা জোর করে হটিয়ে দিলে দ্বিতীয়টাকে। ভয় পেয়েছে হ্যাডন। বেশি কেটে ফেললেও বিপদ, কম কেটে ফেললেও বিপদ।
আচমকা যেন লক গেট খুলে তোড়ে জল বেরিয়ে গেল। দোটানার চিন্তাপ্রবাহ হু-উ-উ-স করে বেরিয়ে গেল ওর চেতনাকেন্দ্রের আলোময় অঞ্চল থেকে। মনস্থির করে ফেলেছে। হ্যাডন। টের পেলাম, শিরা কাটাও হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। ভাঙা গলায় পেঁচিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। ছিটকে সরে গেল পেছনে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। বাদামি-বেগুনি রক্ত। সে কী আতঙ্ক হ্যাডনের। দুই ডাক্তারই আটকোনা টেবিল থেকে স্ক্যালপেল তুলে নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বিপর্যয় রোধ করার জন্যে। আমি কিন্তু জানলাম, মৃত্যু হল আমার সেই মুহূর্তেই–দেহটা অবশ্য তখনও আঁকড়ে রয়েছে আমাকে নাছোড়বান্দার মতো।
সবই উপলব্ধি করলাম। কিন্তু খুঁটিয়ে বর্ণনা আর দেব না। চেষ্টার ত্রুটি করেনি দুজনে আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে। জীবনে এত ধারালোভাবে দ্রুতগতিতে কিছু উপলব্ধি করতে পারিনি। অবিশ্বাস্য গতিবেগে চিন্তা ছুটছে মনের মধ্যে দিয়ে–আশ্চর্য রকমের অনাবিল সুস্পষ্টভাবে। সঠিক মাত্রায় আফিম খেলে চিন্তারাশি যেভাবে গাদাগাদি অবস্থায় থেকেও স্পষ্ট থাকে, আমার তখনকার অবস্থা যেন সেইরকমই। এ ছাড়া আর কোনও উপমা মাথায় আনতে পারছি না। বুঝলাম, এখুনি সব শেষ হয়ে যাবে, মুক্তি পাব আমি। আমি জানি, আমি অমর। কিন্তু কী ঘটবে, তা জানি না। বন্দুকের নল থেকে ফুস করে ধোঁয়া ঠিকরে যায় যেভাবে, সেইভাবেই কি ছিটকে যাব দেহের খাঁচা থেকে? মৃতদের জগতে হাজির হব কি এবার? প্রেতচক্রে হাজির হব নাকি তারপর? বেরং প্রত্যাশা, আবেগহীন কৌতূহলে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম সেই মুহূর্তে। তারপরেই একটা চাপ অনুভব করলাম। উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। যেন একটা অতিকায় মানবিক চুম্বক আমাকে আমার দেহ থেকে টেনে ওপরে তুলে নিয়ে যেতে চাইছে। বাড়ছে… ক্রমশ বেড়ে চলেছে অস্বস্তি। প্রচণ্ড আকর্ষণ আর এড়ানো যাচ্ছে না। অনেকগুলো দানবিক শক্তির সঙ্গে সঙ্গে আমি একটা খুদে পরমাণুর মতো যুঝে চলেছি। পারছি না… প্রচণ্ড এই আকর্ষণকে ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। ক্ষণেকের জন্যে একটা বিশাল কালো তমিস্রা জলপ্রপাতের মতো আছড়ে পড়ে মহা-আতঙ্কের অমানিশায় ডুবিয়ে দিল আমাকে… ভয়াবহ আতঙ্ক চকিতের মতো চাবুক আঘাতে জড়তা কাটিয়ে দিল আমার এক নিমেষের জন্যে। পরক্ষণেই দুই ডাক্তার, ছোট্ট ঘর, পাঁজরা-কাটা দেহ প্রবল জলোচ্ছ্বাসে একটা ফেণা-বুদবুদের মতো ভেসে গেল কোথায় কে জানে।