ভাবাবেগ জিনিসটা যেন একেবারেই মরে গেছে আমার ভেতরে। একেবারেই নির্বিকার। শরীর ভেঙে পড়ার লক্ষণ নিঃসন্দেহে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। হঠাৎ খুব রক্তক্ষরণ হয়েছিল। মরতে বসেছিলাম। তখনকার সেই অনুভূতির ছিটেফোঁটাও আর নেই মনের ভেতরে–নিংড়ে বেরিয়ে গেছে বললেই চলে। নিবিড় প্রশান্তি–ভাগ্যের হাতে নিঃশেষে নিজেকে সঁপে দিলে যা হয়। বেশ কয়েক হপ্তা আগে অনুভূতি, উচ্চাশা, মমত্ববোধ–সবই ছিল পুরো মাত্রায়।
রক্তশূন্য হয়েছি আবার। হপ্তাখানেক কিছুই খেতে পারছি না। খিদেই নেই। মানুষ নামক প্রাণীটাকে চালিত করে যন্ত্রণা আর আনন্দবোধের চক্র। এই চক্র হঠাৎ আমার ভেতর থেকে সরে গেছে। তাই এই উদাসীনতা। ছোটখাটো ভয় আর আকাক্ষা থেকেই বড় রকমের আবেগ, অনুভূতি, মমত্ববোধের সৃষ্টি হয়। মৃত্যুর ছায়াপাত ঘটলেই অবসান ঘটে এই জটিল চক্রবর্তের। উদ্যম তিরোহিত হয়। তখন আর কিছুই থাকে না।
একটা কসাই-ছোকরার বারকোশে ধাঁই করে ধাক্কা খেতেই ছিঁড়ে গেল চিন্তার সুতো। ঘটনাটা ঘটল রিজেন্ট পার্ক ক্যানালের ব্রিজ পেরনোর সময়ে। নীলবসন ছোকরা ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে রয়েছে একটা কালো মালবাহী বড় নৌকোর দিকে। হাড় বার-করা সাদা ঘোড়া গুন টেনে নিয়ে যাচ্ছে নৌকোটাকে। ব্রিজের ওপরে হাত ধরে তিনটে খুশি-খুশি বাচ্চাকে নিয়ে আসছে একজন আয়া। উজ্জ্বল সবুজ গাছ, ঝকঝকে আকাশ, তরঙ্গায়িত কালো জল এবং বসন্তের মৃদুমন্দ সমীরণও নাড়া দিতে পারল না আমার অসাড় মনে।
কীসের পূর্বাভাস এই অসাড়তা? যুক্তিবুদ্ধির ধার তো ভোঁতা হয়নি। কেন এমন হচ্ছে, তা তো বেশ ভাবতে পারছি। অসাড়তা নয়, প্রশান্তি চেপে বসছে চেতনায়। মৃত্যুর পূর্বলক্ষণ নাকি? মন জানতে পেরেছে আগে থেকেই? মৃত্যুর কনকনে আলিঙ্গনে দেহ ঠান্ডা হওয়ার আগেই কি মন নিজে থেকেই এইভাবে সরে আসে জড়জগৎ আর অনুভূতির জগৎ থেকে? দলছাড়া মনে হল নিজেকে। জীবন থেকে, চারপাশের অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার দরুন কিন্তু বিন্দুমাত্র পরিতাপের উদয় ঘটল না মনের মধ্যে। জীবনের চাঞ্চল্য চারদিকে। ছেলেমেয়েরা খেলছে, মালি-আয়ার সঙ্গে গল্প করছে, হাসতে হাসতে পাশ দিয়ে চলে গেল প্রাণবন্ত দুটি তরুণ-তরুণী, রাস্তার পাশের গাছগুলো নতুন পাতা মেলে ধরছে। সূর্যকিরণের দিকে, মর্মরধ্বনি শোনা যাচ্ছে ডালপালার মধ্যে। প্রাণময় এই জগতের অংশ ছিলাম আমিও। এখন নেই। ফুরিয়ে গেছে আমার ভূমিকা।
ক্লান্ত বোধ করছিলাম। পা যেন আর চলছে না। বসলাম রাস্তার পাশের সবুজ চেয়ারে। বেশ গরম পড়েছে। ঢুলুনি এল বসতে-না-বসতেই। তলিয়ে গেলাম অদ্ভুত স্বপ্নের মধ্যে। উদবেল চিন্তা ধুয়ে-মুছে গেল পুনর্জন্মের স্বপ্নদৃশ্যে। বসে রয়েছি চেয়ারেই, কিন্তু প্রাণ নেই দেহে৷ শুষ্ক, জীর্ণ দেহ। একটা চোখ খোবলাচ্ছে কয়েকটা পাখি। জাগ বলে কে হেঁকে উঠতেই বিদ্রোহী হল যেন রাস্তার ধুলো আর ঘাসের তলাকার মাটির ঢিপি। রিজেন্ট পার্কের এই বাগানটাকে কবরখানা বলে কোনওদিনই ভাবতে পারিনি। সেই মুহূর্তে কিন্তু দেখলাম, যত দূর দুচোখ যায়, কেবল কবর আর সমাধিস্তম্ভ। কাঁপছে, দুলছে, শিরশির করছে, কিলবিল করছে। কোথায় যেন একটা বিরাট গোলমাল চলেছে। জাগ্রত মড়ারা কবর ঠেলে উঠে আসতে চাইছে প্রাণপণে! রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ। সাদা হাড় থেকে খসে পড়ছে লাল মাংস। জাগ হাঁক আবার শোনা গেল কানের কাছে। কিন্তু দাঁতে দাঁত কামড়ে বসে রইলাম আমি। জাগুক সবাই, আমি জাগব না। দানোদের দলে ভিড়ব না। চাষাড়ে গলায় আবার জাগতে বলছি না? বলেই কাঁধ ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিল চোয়াড়ে লোকটা। টিকিট চাইছে বাগানের মালি।
পয়সা গুনে দিয়ে টিকিট পকেটস্থ করে, হাই তুলে উঠে পড়লাম চেয়ার ছেড়ে, চললাম ল্যাংহাম প্লেসের দিকে। আবার মৃত্যুর চিন্তা জলপ্রপাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল মনের ওপর। আর-একটু হলে গাড়িচাপা পড়তাম মোড়ের মাথায়। ধাক্কাটা গেল কাঁধের ওপর দিয়ে। রক্ত তো বেরলই, সেই সঙ্গে উত্তাল হল হৃদযন্ত্র। টলতে টলতে সরে এলাম পাশে। কালকের মৃত্যু-ধ্যান আর-একটু হলেই মৃত্যু ঘটিয়ে ছাড়ত এখুনি।
যা-ই হোক, সেই দিনের এবং তার পরের দিনের অভিজ্ঞতা শুনিয়ে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। সময় যতই গড়িয়েছে, ততই নিশ্চিত হয়েছি। কাল অপারেশন হবে এবং আমিও মরব। বাড়ি ফিরে দেখলাম, প্রস্তুতিপর্ব সাঙ্গ হয়েছে। ঘর পরিষ্কার। সাদা চাদর ঝুলছে। নার্স মোতায়েন হয়েছে। জোর করেই শুতে পাঠাল সকাল সকাল।
বড় কুঁড়ে মনে হল নিজেকে সকালবেলা। সকালের ডাকে আসা খবরের কাগজ আর চিঠিপত্র নিয়ে বসলাম বটে, কিন্তু মন দিতে পারলাম না। আমার লেখা নতুন বইটায় কয়েক জায়গায় ত্রুটি আছে, ছাপার ভুলও আছে–লিখেছে স্কুলের বন্ধু অ্যাডিসন। বাকি চিঠিপত্র ব্যাবসা সংক্রান্ত। এক কাপ চা ছাড়া খেতে দেওয়া হল না কিছুই। পাঁজরায়। যন্ত্রণাটা আরও বেড়েছে। কিন্তু অনুভব করতে পারছি না। রাত্রে ঘুমাইনি। মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। তেষ্টা পাচ্ছিল। সকালে কিন্তু বেশ ভালোই লাগল। সারারাত অতীতের ঘটনা ভেবেছি। ভোরের দিকে অমরত্ব নিয়ে ভাবতে ভাবতে চুলেছি। ঘড়ি ধরে ঠিক সময়ে এল হ্যাডন–হাতে কালো ব্যাগ। মোব্রে এল তার পরেই। ওরা আসতে জবুথবু ভাবটা একটু কাটল। আটকোনা ছোট টেবিলটা খাটের পাশে এনে রাখল হ্যাডন। আমার দিকে পেছন ফিরে ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে রাখতে লাগল টেবিলে। শুনলাম স্টিলের ওপর স্টিল রাখার আওয়াজ। চিন্তাধারা আর ডোবা জলের মতো বদ্ধ নয়। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ছুরি চালালে খুব লাগবে কি?