এবং, তৎক্ষণাৎ পপাত ধরণিতলে হল অলৌকিক লক্ষ! দড়াম করে পড়ল মেঝেতে। ঢং ঢং ঢং শব্দে কয়েকবার নেচে নিয়ে দপদপ করে শিখা নিবিয়ে।
গড়িয়ে গিয়ে স্তব্ধ হল ঘরের কোণে।
ভাগ্যিস ধাতুর তৈরি তৈলাধার ছিল লক্ষে–তাই অগ্নিকাণ্ডটা ঘটল না। পুরো ঘরখানায় আগুন লেগে যেত, তৈলাধার যদি কাচের তৈরি হত। প্রথম কথা ফুটল মি. কক্সের কণ্ঠে। বিন্দুমাত্র বাগাড়ম্বর না করে ফোদারিনগে- কে আহাম্মক বলা হল কাটছাঁট ভাষায়। প্রতিবাদ করার মতো অবস্থা তখন নেই ফোদারিনগে বেচারির। বাঁইবাঁই করে ঘুরছে মাথা। ঘরসুদ্ধ লোক একমত হল তার হাতসাফাইয়ের কারবারে এবং বেরিয়ে যেতে বললে ঘর থেকে। এবংবিধ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারল না বিমূঢ় ফোদারিনগে।
বাড়ি ফিরল চোখ-মুখ লাল করে। কান গরম, মাথা ভোঁ ভোঁ। আসবার পথে দুধারে রাস্তার বাতিস্তম্ভগুলোর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে এসেছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল চার্ট রো-স্থিত নিজস্ব খুদে কামরায় ঢোকার পর। মোটামুটি সুস্থিত হয়ে ভাবতে বসল উদ্ভট ব্যাপারটা নিয়ে।
কোট আর বুট খুলে বিছানায় বসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেই নিয়ে সপ্তদশ সাফাই গাইল নিজের মনেই–সত্যি সত্যিই তো চাইনি উলটে যাক হতচ্ছাড়া লক্ষ!
কিন্তু উলটে তো গিয়েছিল মুখ দিয়ে কথাটা বার করার সঙ্গে সঙ্গে। কীভাবে যে ঘটল কাণ্ডটা, তা বিলক্ষণ ধোঁয়া ধোঁয়া ফোদারিনগের নিজের কাছেই। ইচ্ছাশক্তি একাগ্র করার জন্যে খুব যে একটা কস্তাকস্তি করতে হয়েছিল মনের সঙ্গে, তা মোটেই নয়। মনের কোনও প্রস্তুতিই ছিল না। ফট করে লক্ষ বেটাচ্ছেলে উলটে যেতেই ভীষণ দায়িত্বটা ধাঁ করে চেপে বসেছিল কাঁধেওলটানো অবস্থাতেই রেখে দিতে হবে হারামজাদাকে। কীভাবে –তা তো জানা ছিল না। তারপর যা ঘটে গেছে, তার কোনও যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা ফোদারিনুগের মগজে অন্তত আসছে না।
দেখাই যাক-না অঘটনটা আবার ঘটানো যায় কি না। নিষ্কল্প তর্জনী তুলে ধরেছিল ঘরের মোমবাতির দিকে। এলোমেলো মনটাকে বেঁধেহেঁদে, জড়ো করেছিল এক জায়গায়। কাজটা নেহাতই আহাম্মকি, তা বুঝেও যাচাই করার লোভ সামলাতে পারেনি।
বলেছিল, বাপু হে, উঠে পড় তো শূন্যে।
বলেই তো থ!
শূন্যে ভেসে উঠেছে মোমবাতি।
বেশ ভাসছিল নিরবলম্বভাবে। কিন্তু মি. ফোদারিনগে খাবি খেতেই ঘটল বিপত্তি। শূন্যাবস্থান পরিত্যাগ করে দড়াম করে আছড়ে পড়ল টেবিলে। অন্ধকার ঘরে কেবল দেখা গেল নিবে-যাওয়া পলতের দীপ্তি।
ক্ষণেকের জন্যে এক্কেবারে নট-নড়নচড়ন নট-কিছু হয়ে তমিস্রার মধ্যে ভূতের মতো বসে ছিল মি. ফোদারিনগে।
তারপর পাঁজর-খালি-করা বিরাট এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট হাতড়েছিল দেশলাইয়ের খোঁজে। পায়নি। হাতড়েছিল টয়লেট টেবিলে। সেখানেও পায়নি। তারপরেই খেয়াল হয়েছিল, মির্যাকল ঘটিয়ে দেশলাইও তো আনতে পারে হাতের মুঠোয়। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল বোকা-বোকা স্বরে, এসে যাক একটা দেশলাইয়ের কাঠি হাতের চেটোয়।
টুপ করে কী যেন পড়েছিল হাতের চেটোয়। মুঠো পাকাতেই আঙুল চেপে বসেছিল একটা দেশলাইয়ের কাঠির ওপর।
বারকয়েক কাঠি জালানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ফোদারিনগে বুঝেছিল, কাঠিটা সেফটি ম্যাচ–তাই জ্বলছে না। ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুড়ত করে আবার একটা ইচ্ছে ঢুকে পড়েছিল মাথার মধ্যে। ইচ্ছাশক্তি দিয়েই তো জ্বালানো যায় কাঠিমহাশয়কে। তৎক্ষণাৎ প্রয়োগ করেছিল শক্তিটাকে–কাঠি, জ্বল তো বাপু নিজে থেকে। টয়লেট টেবিলের কাপড়ের ওপর দপ করে কাঠি জ্বলে উঠতেই ধড়ফড় করে তুলে নিয়েছিল ফোদারিনগে-ফলে, নিবে গিয়েছিল কাঠি।
সম্ভাবনার ক্ষেত্রটা তখন সম্প্রসারিত হয়েছিল মাথার মধ্যে। হাতড়ে হাতড়ে মোমবাতিটা তুলে নিয়ে বসিয়েছিল শামাদানে। বলেছিল, জ্বলে ওঠ তো বাপু মোমবাতি! তখুনি দপ করে প্রজ্বলিত হয়েছিল মোমবাতির পলতে। সেই আলোয় ফোদারিনগে মশায় দেখেছিল, টয়লেট টেবিলের ঢাকনায় একটা ছোট্ট ফুটো-ধোঁয়া উঠছে ফুটোর কিনারা ঘিরে। ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মোমবাতির শিখায় দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল বিমূঢ় মানুষটা। অতঃপর আয়নায় দেখেছিল নিজের মুখের চেহারা এবং নিঃশব্দে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে গিয়েছিল নিজেরই প্রতিফলনের সঙ্গে।
প্রথম শব্দহীন প্রশ্নটা ছিল এই: মির্যাল কি একেই বলে?
ধ্যানস্থ অবস্থায় এরপর এমনই আবোল-তাবোল প্রশ্নোত্তর চলেছিল নিজের সঙ্গে, যা রীতিমতো গোলমেলে–আরও গোল পাকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল মাথার মধ্যে। মোটের ওপর একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। যা কিছু ঘটছে, সবই তার নির্ভেজাল ইচ্ছাশক্তির জোরেই ঘটছে। প্রথম এক্সপেরিমেন্টগুলোয় অনেক অনর্থ ঘটানোর পর পরবর্তী পরীক্ষানিরীক্ষায় হুঁশিয়ার না হয়ে পারেনি। তবে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে এক তা কাগজ তুলেছিল শূন্যে, রং পালটেছিল এক গেলাস জলের প্রথমে গোলাপি, তারপর সবুজ। সৃষ্টি করেছিল একটা পুঁচকে গেঁড়ি এবং নিশ্চিহ্নও করেছিল অত্যাশ্চর্যভাবে। শূন্য থেকে একটা অত্যাশ্চর্য দাঁত-মাজা বুরুশ আনিয়েছিল নিজের ব্যবহারের জন্যে। এইসব করতে করতেই ঘড়িতে রাত একটা বাজতেই খেয়াল হয়েছিল, অত্যাশ্চর্যভাবে রোজকার কেরানিগিরির দফরফা হয়ে যেতে পারে পরের দিন, যদি-না এখুনি একটু ঘুমিয়ে নেয়। জামাকাপড় ছাড়তে গিয়ে শার্টটাকে মাথা গলিয়ে বার করার সময়ে হিমশিম খেতে খেতে হুকুম দিয়েছিল অজান্তেই–নিয়ে যাও আমাকে বিছানায়– বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখেছিল, দিব্যি লম্বমান রয়েছে খাটের ওপর। তারপর হুকুম দিয়েছিল, এবার ভোলা হয়ে যাক জামাকাপড়। পরক্ষণেই দিগম্বর অবস্থায় শীতে কাঁপতে কাঁপতে ধড়ফড় করে ঝেড়েছিল নয়া হুকুম, আমার রাতের শাট এসে যাক গায়ে-না, না, খুব নরম মোলায়েম উলের রাত্রিবাস চাই। আঃ! কী আরাম! আসুক এবার আরামের ঘুম!…