ওই তো স্বর্গ! ওই তো দেবতাদের আলয়! মহান ওই সৌন্দর্য দেখে অকস্মাৎ তার মনে হয়েছিল, অপরূপ এই দৃশ্যের তুলনায় অন্ধদের এই নিকেতন একটা বদ্ধ বিবর ছাড়া কিছুই নয়–পাপাত্মা-পরিবেষ্টিত হয়ে এই পাপপুরীতে, ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ প্রসাদবঞ্চিত এই অন্ধ মানুষদের দেশে অন্ধত্ব অর্জন করে তাকেও কি সরে আসতে হবে স্বর্গের কাছ থেকে? এমনকী স্বর্গদৃশ্যও মুছে দিতে হবে চিরতরে চোখের সামনে থেকে?
পুষ্পসমৃদ্ধ কানন থেকে ফিরে যাবে–এইটাই মনস্থ করেছিল কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু সহসা আকাশ আর উচ্চ পর্বতালয়ের অজস্র বর্ণদীপ্ত সুষমা অবসান ঘটাল উভয়সংকটে অস্থির চিত্তবিক্ষেপের। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সম্মুখে। প্রাচীরের ওপারে সাঁকো পেরিয়ে আরোহণ করতে লাগল পাহাড় বেয়ে, সম্মোহিতের মতো কিন্তু আগাগোড়া চেয়ে রইল চিত্ত-অবশকারী অনিন্দ্যসুন্দর তপন-প্রদীপ্ত তুষার আর বরফের পানে।
অনন্ত সৌন্দর্য দেখে তিরোহিত হল তার অন্তরের বিষাদের যবনিকা। অশুচি জগৎ থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার নীরব আহ্বান সে উপলব্ধি করেছে, হৃদয়ের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রীতে ধ্বনিত হয়েছে পরম কারুণিকের অমোঘ আহ্বান–শক্তি সঞ্চারিত হচ্ছে পেশিতন্ত্রীতে। জাগরূক হচ্ছে কল্পনা–উন্মোচিত হচ্ছে স্মৃতির আধার। মনে পড়ছে ফেলে-আসা বাগোটাকে। যেখানে দিনের আলো সগর্বে কর্মচঞ্চল রাখে চক্ষুষ্মনদের, নিশীথের রোমাঞ্চ নিদ্রিত করে কর্মক্লান্ত মানুষকে। বিস্তর প্রাসাদ, অট্টালিকা, নিকেতন আছে যেখানে, আছে পথ, যানবাহন। আরও দূরে আছে দিগন্তব্যাপী সুনীল জলধি। নদীপথে দিনের দিন বহু অ্যাডভেঞ্চারের পর পৌঁছানো যায় সীমাহীন সেই জলরাশির উত্তাল তরঙ্গশীর্ষে শুরু হয় বৃহত্তর দুঃসাহসিকতা–জীবনমৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে, মত্ত প্রভঞ্জনের সঙ্গে লড়াই করে টহল দিয়ে আসা যায় বিশাল ভূগোলকটিকে।
আশ্চর্য উদার বিশাল সেই দুনিয়ার সামনে যবনিকা তো ওই পর্বত প্রাচীর। অতীব খাড়াই দুর্গম এবং দুরারোহ।
চোখ কুঁচকে আসে নানেজের। নির্নিমেষে চেয়ে থাকে প্রদীপ্ত পর্বতশিখরগুলোর দিকে।
চেষ্টার অসাধ্য কিছু আছে কি? দুপাহাড়ের ফাঁকে ওই খাঁজের খোঁচা খোঁচা পাথরে পা দিয়ে সন্তর্পণে উঠে যাওয়া কষ্টকর হতে পারে, অসম্ভব নয়। অচিরেই পৌঁছে যাবে পাইন। অরণ্যে। চাতালের মতো পাথরে ওই যে কিনারাটা দেখা যাচ্ছে, ওখান দিয়ে উঠে যাবে আরও উঁচুতে গিরিবর্জ্যের মাথার দিকে। তারপর নিশ্চয় ভাগ্য সহায় হবে। প্রকৃতি তাকে ডাক দিয়েছে–প্রকৃতিই তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। তুষাররেখার নিচেই ওই চিমনি দিয়ে উঠবে আরও ঊর্ধ্বে–একটা চিমনিপথ দুরারোহ হলে আরও একটা খুঁজে নেবে। তার চোখ আছে, চোখ মেলে সে পথের বাধা দূর করতে পারবে না? একসময়ে নিশ্চয় পৌঁছে যাবে অম্বর-আলোকিত তুষারলোকে–ধু ধু শূন্যতার মধ্যে পাবে মুক্তির স্বাদ, স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের নতুন পথ…
ফিরে তাকালে গ্রামের দিকে। চেয়ে রইল চোখের পাতা না ফেলে।
মনে পড়ল মেদিনা-সারোতের কথা। বহু দূরে অস্পষ্ট বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছে তার নিষ্কম্প মূর্তি।
চোখ ফেরালে পর্বত প্রাচীরের দিকে দিনের আলোর ঢল নামছে প্রাচীর বেয়ে।
তনু-মন সংহত করে শুরু হল পর্বতারোহণ।
সূর্যাস্ত। নানেজ আর পাহাড় বেয়ে উঠছে না। নিশূপ দেহে শুয়ে আছে। অধরপ্রান্তে অসীম প্রশান্তির নিবিড় হাস্যরেখা। পোশাক যদিও শতচ্ছিন্ন, হাত-পা রক্তারক্তি, সারা গায়ে কালশিটের নীল বর্ণ, তা সত্ত্বেও আত্মপ্রসাদের অনাবিল প্রশান্ত হাসিতে সমুজ্জ্বল মুখ।
এত উঁচু থেকে অন্ধদের গ্রামটাকে মনে হচ্ছে যেন একটা গভীর বিবর। মাইলখানেক নিচে একটা বদ্ধ উপত্যকা। গোধূলির অস্পষ্টতা গ্রাস করছে অভিশপ্ত উপত্যকাকে একটু একটু করে। মাথার ওপরে শিখরগুলোয় অগ্নিদেবের রোশনাই যেন খুশির পেখম মেলে ধরেছে। হাতের কাছেই ঝলমল করছে আরও অপরূপ সৌন্দর্য। সবুজ খনিজ মিশেছে ধূসর খনিজে। ক্রিস্টালের চমক-দ্যুতি চোখ ঝলসে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। বিশাল খাদগুলোর মধ্যে অসীম রহস্যময়তার মধ্যে নীলাভ আর বেগুনি আভা। তমিস্রার ক্রীড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। মাথার ওপর পরমানন্দে হাসছে আলোকময় আকাশ।
এই তো স্বর্গ। অন্ধদের দেশে রাজা হওয়ার বাসনা আর তার নেই।
রাত ঘনীভূত হল। নিবিড় তমিস্রায় গা এলিয়ে শুয়ে শীতল নক্ষত্ররাজির পানে নির্নিমেষে চেয়ে রইল নানেজ…
আত্মার ব্রহ্মাণ্ড পর্যটন
আত্মার ব্রহ্মাণ্ড পর্যটন ( Under the Knife )
[‘Under the Knife’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘The New Review’ পত্রিকায় জানুয়ারি ১৮৯৬ সালে। ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘The Country of the Blind and Other Stories’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়।]
হ্যাডনের বাড়ি থেকে ফেরবার পথে কেবলই ভাবছিলাম, কাল যদি মরে যাই তো কী হবে? বউ নেই যে কাঁদবে, বন্ধুবান্ধব যা আছে, তাদের ব্যাপারে আমি এমনই নিস্পৃহ যে, মোটেই শোকে বিহ্বল হবে না। বাল্যবন্ধু ছাড়া জীবনের শেষ ভাগে কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী আর শুভাকাক্ষীও জুটিয়ে ফেলেছি, কিন্তু এদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই আমি এতই উদাসীন যে, আমার মৃত্যুতে তাদের যেমন কোনও মাথাব্যথা নেই–আমারও তা নিয়ে অযথা মস্তিষ্কপীড়ন নেই। সুতরাং দুনিয়ায় কেউ কেঁদে ভাসিয়ে দেবে না কালকের অপারেশনে আমি অক্কা পেলে।