আস্তে আস্তে অন্ধদের মধ্যে ভিড়ে গেছে নানেজ৷ ইয়াকুবের গোলাম হয়ে সারারাত খেটেছে খেতে। ইয়াকুব লোকটা ভালো, না রেগে গেলে। তার ছোট মেয়ে মেদিনা-সারোতে কিন্তু দিদিদের মতো দেখতে নয়। সুঠাম মুখশ্রী। চোখ অক্ষিকোটরে ঢোকানো নয়। চোখের পাতাও নড়ে। যেন ইচ্ছে করলেই দৃষ্টিশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। কণ্ঠস্বর মোলায়েম নয়। অন্ধদের কাছে এইসব কারণেই সে সুন্দরী নয়। যার চোখ ঠেলে থাকে, চামড়া রুক্ষ, স্বর কানে বাজে–তার কি বর জোটে?
নানেজের কিন্তু পছন্দ হয়েছিল তাকে এইসব কারণেই। আড়ালে পেলেই তাকে শোনাত বহির্জগতের কথা, এই সুন্দর বিশ্বের বর্ণসুষমার কথা। কান পেতে একমনে শুনত সে। তারপর একদিন বিয়ের কথা উঠতেই বেঁকে বসল তার দিদিরা। এমনকী গাঁয়ের যুবকরাও। মেদিনা-সারোতে অসুন্দরী–তা-ই বলে কি একটা জরদৃগবের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বিকৃত প্রজন্মের সূচনা করতে হবে? রক্ত অশুচি করতে হবে? কক্ষনো না। একজন তো মেরেই বসল নানেজকে। নানেজ পালটা মার দিয়ে শুইয়ে দিলে তাকে।
এবং সেই প্রথম হাতেনাতে দেখিয়ে দিলে, হাতাহাতি মারপিটে চোখ কত কাজে লাগে।
তারপর থেকে কেউ আর তার গায়ে হাত দেয়নি। মেদিনা-সারোতে কিন্তু কেঁদে পড়েছিল বাবার কাছে। মেয়ের কান্নায় গলে গিয়ে গাঁয়ের প্রবীণদের পরামর্শ নিতে গিয়েছিল ইয়াকুব। ভেবেচিন্তে একজন বয়োবৃদ্ধ শুনিয়েছিল আশার বাণী। নানেজকে তাদের মতো করে নেওয়া যাবে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে। ওর মাথার গোলমাল ঘটছে চোখ নামক ঠেলে বেরিয়ে থাকা ওই অদ্ভুত রোগগ্রস্ত প্রত্যঙ্গটা থেকে। মগজে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে ওই জিনিসটা। যত উদ্ভট কল্পনার সৃষ্টি ওইখান থেকেই। অস্ত্রোপচার করে জিনিসটাকে বাদ দিলেই নানেজ সুস্থ হয়ে উঠবে, ইয়াকুবের জামাই হতে পারবে।
কিন্তু বেঁকে বসেছিল নানেজ। বাকি জীবনটা এই অন্ধদের দেশেই তাকে থাকতে হবে ঠিকই, রাজার মতো নয়, ক্রীতদাসের মতো। কিন্তু চক্ষুর বিসর্জন দিয়ে কারও জামাই হতে সে রাজি নয়।
নিঃশব্দে কেঁদেছিল মেদিনা-সারোতে। নানেজের কল্পকাহিনি শুনতে তার ভালো লাগে। ভালো লাগে তার সঙ্গ। তাহলে কেন রাজি হচ্ছে না? সামান্য একটু ব্যথা পাবে বই তো নয়, তারপরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
অশ্রুসিক্ত মিষ্টি মুখখানার পানে অনিমেষে চেয়ে থেকে অবশেষে রাজি হয়েছিল নানেজ!
অস্ত্রোপচারের এক সপ্তাহ আগে মহা উদ্যমে অন্ধরা তাকে শিক্ষাদান করে গেল, পরিমার্জনা এবং পরিশোধনের বিস্তর আয়োজন করল, গোলামি আর নিকৃষ্ট সত্তাটাকে উন্নততর করে অন্ধদের পর্যায়ে তাকে নিয়ে আসার জন্যে কোনও প্রয়াসই বাকি রাখল না। নানেজের চোখ থেকে ঘুম উড়ে গিয়েছিল। দিবাভাগের অরুণ-কিরণদীপ্ত অন্ধ-নিকেতনে যখন দৃষ্টিহীনরা সুষুপ্ত, নানেজ তখন নিবিষ্ট চিন্তায় নিমগ্ন থেকে বিমর্ষচিত্তে ইতস্তত পরিভ্রমণ করেছে লক্ষ্যহীনভাবে। উভয়সংকটের দুশ্চিন্তা বহু বিষধর সরীসৃপের মতো তার শিরায়-ধমনিতে বিচরণ করেছে, তাকে অস্থির চঞ্চল করে তুলেছে। দুর্ধর্ষ দুঃসাহসিকতায় দুর্দান্ত সে চিরকালই, কিন্তু অন্ধ-আলয়ে আজ সে নিতান্তই অসহায়। পর্বতারোহীর জীবনযাপনে অভ্যস্ত বলেই মৃত্যুকে পরোয়া করেনি কোনওদিনই, অকুতোভয় মানুষটার ধারেকাছেও তাই মৃত্যু তার করাল ছায়া ফেলতে সাহসী হয়নি। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতিতে পড়েছে, তার চাইতে মৃত্যুর শীতল আলিঙ্গনও অনেক বরণীয়। অথচ সম্মতি দিয়েছে চক্ষুরত্ন উৎপাটনের। কাজের প্রহর শেষ হলেই বিপুল ঐশ্বর্যসম্ভার নিয়ে বর্ণময় শিখরে শিখরে জীবনের সুবর্ণশোভা মেলে ধরে তপনদেবের আবির্ভাব ঘটতেই আরও মুষড়ে পড়ল নানেজ। আজই শেষ দিন। ঈশ্বরের দেওয়া ঐন্দ্রজালিকের ক্ষমতাসম্পন্ন এই চক্ষু প্রত্যঙ্গটিকে বিসর্জন দিতে হবে আজকে, নিশুতি রাতে। মেদিনা-সারোতের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে কোমল কণ্ঠে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে গেছে নানেজকে। ক্ষণিকের যন্ত্রণাবোধের পরেই নানেজ পাবে চিরশান্তি, মগজের অহরহ যন্ত্রণা মিলিয়ে যাবে চিরতরে, অচিন্ত্যপূর্ব প্রশান্তিতে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে নানেজ।
নিমেষহীন নয়নে নয়ন-প্রসাদে বঞ্চিত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে বিদায় জানিয়েছে নানেজ। অসীম করুণায় আর্দ্র হয়েছে চিত্ত।
বিদায় জানিয়েছে দুই করতল মুঠির মধ্যে তুলে নিয়ে। বলেছে স্নেহক্ষরিত স্বরে, বিদায়।
নিঃশব্দে সরে গিয়েছে দূর হতে দূরে। পায়ের শব্দ কান পেতে শুনেছে মেদিনা সারোতে। ক্রমশ ক্ষীণতর হয়ে আসছে কিন্তু দৃঢ় পদধ্বনি। পদধ্বনির মধ্যে জাগ্রত হয়েছে এমন একটা ছন্দ, যা যাত্রার আগে ধরা পড়েনি মেদিনা-সারোতের আতীক্ষ্ণ শ্রবণযন্ত্রে। তাই অকস্মাৎ প্রবল আবেগে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে।
নানেজ চেয়েছিল, জনশব্দহীন নিরালা কোনও তৃণভূমিতে গিয়ে নিবিষ্ট থাকবে অন্তরের অন্তঃস্থলের দুঃসহ চিন্তায়। যে আবেগ প্রবল বন্যার মতো উৎসারিত হচ্ছে মনের গহনতম অঞ্চল থেকে, তাকে আর বাঁধ দিয়ে ধরে রাখতে পারছে না। ঘাস, সবুজ প্রান্তরের নার্সিসাস পুষ্পের পাশে একলা বসে থাকবে চক্ষু বিসর্জনের সময় আগত না-হওয়া পর্যন্ত। যেতে যেতে বিহ্বলভাবে দুচোখ তুলে তাকিয়েছিল অজস্র বর্ণে প্রদীপ্ত ভোরের আকাশের দিকে। দেখেছিল, উষাদেবী যেন সোনার বর্ম পরে নেমে আসছে কাঞ্চন-সোপান বেয়ে।