একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারেনি নানেজ। তার যে চোখ আছে এবং আশ্চর্য এই প্রত্যঙ্গটার ক্ষমতা কতখানি, তা সমঝে দেওয়ার এই তো সুযোগ। হেসে উঠে বলেছিল, এই তো আমি।
কাছে এসো।
ইচ্ছে করেই রাস্তা ছেড়ে ঘাসের ওপর পা দিয়েছিল নানেজ–যাতে শব্দ না করে এগিয়ে গিয়ে চমকে দেওয়া যায় মূঢ় অন্ধটাকে।
ধমক খেয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। ঘাসে পা দেওয়া হচ্ছে কেন? রাস্তা থাকতে ঘাসের ওপর যায় তো খোকাখুকুরা? বুদ্ধিশুদ্ধি, জ্ঞানগম্যি কি একেবারেই নেই?
অট্টহেসে জবাব দিয়েছিল নানেজ, চোখ তো আছে, তোমাদের মতো অন্ধ নই।
অবাক হয়ে গিয়েছিল দৃষ্টিহীন গ্রামবাসী। চোখ আর অন্ধ, এ দুটো শব্দ তার জানা নেই। বাঁচালতা আর প্রলাপ বকা যেন বন্ধ করে আগন্তুক। এখনও অনেক জানবার আছে এই দুনিয়ায়। আস্তে আস্তে সব শিখিয়ে নেওয়া যাবে।
সে কী হাসি নানেজের, তাহলে একটা গান শোনাই শোন… একচক্ষুও জেনো রাজা অন্ধদের সেই দেশে।
আবার ধমক খেতে হয়েছিল গান শোনাতে গিয়ে। অন্ধ আবার কী? অন্ধ বলে কোনও শব্দ আছে নাকি?
এইভাবেই গেল চারটে দিন, চারটে রাত। অন্ধদের দেশে রাজা হওয়ার বাসনা তিরোহিত হল একটু একটু করে। পয়লা নম্বরের অপদার্থ এই বিচিত্র জীবটাকে নিয়ে নাজেহাল হয়ে গেল অন্ধরা। দৃষ্টিশক্তি তাদের নেই ঠিকই, কিন্তু আছে আশ্চর্য প্রখর শ্রবণশক্তি আর ঘ্রাণশক্তি। দূর থেকেই হৃৎস্পন্দন শুনে আর গায়ের গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারে, কে আসছে এগিয়ে, আর কে যাচ্ছে দূরে। লাম্যারা নির্ভয়ে নেমে আসে পর্বত থেকে জুগিয়ে যায় খাদ্য, পরিধেয় এবং দুগ্ধ। চাষবাস করে নিখুঁতভাবে। জমি কর্ষণ করে সুচারুভাবে। পথঘাট মসৃণ–উঁচুনিচু নেই কোথাও। মেহনত করে রাতে ঘুমায় দিনে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত তো পেয়ে যাচ্ছে অল্পায়াসেই। বাড়তি সময়টুকু কাটায় গানবাজনা নিয়ে। অবসর বিনোদনের আয়োজনে ত্রুটি নেই কোথাও। সরল গ্রাম্য জীবন। জটিলতাবিহীন ধর্মভীরু মানুষ। নিটোল স্বাস্থ্যের অধিকারী। ছেলেপুলে-বউ নিয়ে সুখের সংসার।
চক্ষুরত্নের ব্যবহার তাই তাদের বোঝাতে পারেনি নানেজ। তিতিবিরক্ত হয়ে বিদ্রোহী হল একদিন।
জোর করে জ্ঞান দিতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি। অন্ধদের ধারণা ছিল, লাম্যারা যেখানে বিচরণ করে–পৃথিবীর শেষ সেইখানেই। মাথার ওপর আছে পাথুরে ছাদ। সূর্য, চন্দ্র, তারা, মহাকাশ, মেঘ–কিসসু নেই।
নানেজের মুখে উলটো কথা শুনে তারা ভাবলে, নানেজ তাদের মন্দ শেখাচ্ছে। অধার্মিকের মতো এ জাতীয় কথাবার্তা তারা শুনতে চায় না। প্রথম প্রথম কান পেতে শুনত নানেজের কথা। শুনত এই পৃথিবীর সীমাহীন বিশালতা আর অপরূপ সৌন্দর্য বর্ণনা। কিন্তু চোখ যাদের নেই, তাদের কাছে এসব কথা দুষ্ট কথা ছাড়া কিছুই নয়। তাই আরম্ভ হল বকাঝকা। তা সত্ত্বেও দমেনি নানেজ। চোখ না-থাকার কত অসুবিধে, বুঝিয়ে দেবার জন্যে একদিন বলেছিল, পেড্রো আসছে সতেরো নম্বর রাস্তা দিয়ে। তোমরা দেখতে পাচ্ছ না, আমি পাচ্ছি। পেড্রো কিন্তু সতেরো নম্বর রাস্তা ছেড়ে আড়াআড়িভাবে চলে গেল অন্য রাস্তায়, কাছে এল না। শুরু হল টিটকিরি। পরে যখন শুনল পেড্রো, রেগে আগুন হল নানেজের ওপর। কুশিক্ষা দেওয়া হচ্ছে গাঁয়ের মানুষদের, নানেজ তাই শত্রু হয়ে উঠল তাদের কাছে।
তবুও হাল ছাড়েনি নানেজ। রাজা হওয়ার বাসনা উগ্রতর হয়ে উঠেছিল রক্তের মধ্যে। মাঠের মধ্যে গিয়ে অন্ধদের চক্ষুরত্নের ক্ষমতা বোঝাতে চেয়েছিল। হাসি-মশকরা শুনে মাথার ঠিক রাখতে পারেনি। বুঝিয়ে যখন কিছু হল না, বলপ্রয়োগে রাজা হবে ঠিক করেছিল। একটা কোদাল কুড়িয়ে তেড়ে মারতে গিয়েও থমকে গিয়েছিল।
অন্ধকে তো এভাবে মারা যায় না!
নিশ্চুপ দেহে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল অন্ধরা। টের পেয়েছিল, কোদাল কুড়িয়ে নিয়েছে নানেজ! হুকুমের স্বরে বলেছিল কোদাল ফেলে দিতে। শোনেনি নানেজ। গাঁ থেকে দল বেঁধে বেরিয়ে এসেছিল অন্ধরা কোদাল আর শাবল নিয়ে। অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে ফেলেছিল তাকে বাতাসের গন্ধ শুঁকে। মাড়িয়ে-চলা ঘাসের ওপর পা ফেলে ফেলে নির্ভুল লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছিল ধীরগতিতে। রাগতস্বরে ফের বলেছিল কোদাল ফেলে দিতে। নানেজ শোনেনি। ভয় পেয়েছিল সেই প্রথম। চোখ নেই, অথচ পায়ে দলা ঘাস আর বাতাসে গায়ের গন্ধ শুঁকে অন্ধরা তাকে ঘিরে ফেলেছে কোদাল-শাবল হাতে। রাজা হওয়া তো দূরের কথা, এখন পালাতে পারলে বাঁচে। একজনকে মরিয়া হয়ে শাবল দিয়ে এক ঘা কষিয়ে পাগলের মতো দৌড়ে গিয়েছিল পাঁচিলের কাছে। কিন্তু মসৃণ আস্তরণ বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়। অদূরে ছিল একটা ছোট্ট দরজা। দরজা পেরিয়ে সাঁকো, তারপর পাহাড়। লাম্যাদের বিচরণ স্থল। সেইখানেই পালিয়েছে নানেজ। দুদিন দুরাত খাবার জোটাতে পারেনি। রাজা হওয়ার সাধ ফুরিয়েছে এইভাবেই।
অবশেষে পুঁকতে ধুঁকতে নেমে এসেছে অন্ধদের মধ্যে। হ্যাঁ, সে অন্যায় করেছে। চোখ বলে কোনও প্রত্যঙ্গ নেই। দৃষ্টিশক্তি অবান্তর কথা। মাথার ওপর পাথুরে ছাদ ছাড়া আর কিসসু নেই, আকাশ, নক্ষত্র, মেঘ, সব বাজে কথা। ভুল করেছে সে। ক্ষমা চায়। বড় খিদে পেয়েছে। খাবার চায়।
ক্ষমা পেয়েছিল সহিষ্ণু অন্ধদের কাছে। বেত্রাঘাত আর অন্ধকার ঘরে বন্দি–এই শাস্তিভোগের পর আর পাঁচজনের মতোই সরাসরি কুলির মতো খাটতে হয়েছে মাঠেঘাটে। তার মতো নির্বোধ জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এর চাইতে বড় কাজ দিতে চায়নি অন্ধরা। অসুস্থ হয়েছিল, সেবা পেয়েছে। প্রবীণরা এসে জ্ঞান দিয়েছে–মনের বিভ্রান্তি ঘোচাতে চেয়েছে।