নানেজ বোঝাতে চেয়েছে, তার দেশ বাগোটা নামক জায়গায়, অনেক দূরে, পাহাড়ের ওপারে।
কিন্তু বাগোটা নামটাই যে তাদের কাছে নতুন। রঙ্গপ্রিয় একটা বাচ্চা বলে উঠেছে, অদ্ভুত মানুষটার নাম নাকি বাগোটা, আধো আধো বুলি ফুটেছে মুখে, তাই ভালো করে কথাও বলতে পারছে না। ফোড়ন দিয়েছে পেড্রো। নানেজের সবকিছুই নাকি কচি খোকার মতো। নির্ভুল পদক্ষেপে হাঁটতেও শেখেনি। নইলে আসবার সময়ে দু-দুবার হোঁচট খায়?
ধৈর্য ফুরিয়ে আসছিল নানেজের। স্নায়ুর ওপর এই ধরনের ধকল যাবে, আগে ভাবেনি। নারী-পুরুষ, বাচ্চাকাচ্চা প্রত্যেকেই তাকে অদ্ভুত জীব মনে করছে, হাসছে, টিটকিরি দিচ্ছে।
তারপর তাকে ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল প্রবীণদের আস্তানায়। গাঢ় আঁধারে ভরা একটা ঘরে, এক হাত দূরেও চোখ চলে না। এক কোণে ম্যাড়ম্যাড় করে জ্বলছে একটা আগুন। হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল নানেজ। পড়বার সময়ে বাতাস আঁকড়ে ধরতে গিয়ে হাত লেগেছিল একজনের মুখে, অন্ধকারে তাকে দেখা যায়নি, কিন্তু রাগে চেঁচিয়ে উঠেছিল সে। পেছন থেকে ভয় ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে পেড্রো বলেছিল, নতুন জীবটার সবকিছুই এখনও অপরিণত। হাঁটে টলে টলে, কথা বলে আধো আধো।
রেগেমেগে প্রতিবাদ করেছিল নানেজ। অন্ধকারে দেখা যায় না বলেই সে হোঁচট খেয়েছে, অত চেপে ধরে রাখার প্রয়োজন নেই। ছেড়ে দিলেই তো হয়। ঘর ভরতি অন্ধরা শলাপরামর্শ করে নিয়ে হাত সরিয়ে নিয়েছিল নানেজের গা থেকে।
যার সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিল নানেজ, বয়সে সে বৃদ্ধ। অচিরেই শোনা গিয়েছিল তার কণ্ঠস্বর। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গিয়েছিল নানেজকে। নানেজ ধীরস্থিরভাবে বলেছিল তার কাহিনি। বহির্জগতের বিস্ময়, বিশাল দুনিয়া, অনন্ত আকাশ, সুউচ্চ পর্বত, দিগন্তব্যাপী সমুদ্র, সে যা দেখেছে দুচোখ ভরে, সব জ্ঞানই উজাড় করে দিয়েছিল বৃদ্ধের সামনে। আরও অনেক বয়োবৃদ্ধ বসে ছিল অন্ধকারময় সেই প্রকোষ্ঠে। দিনের আলো ক্ষীণভাবে দেখা যাচ্ছিল প্রবেশপথে। জানলা নেই দেওয়ালে। আসবার সময়ে অদ্ভুত এই ব্যাপারটাও লক্ষ করেছিল নানেজ। সারি সারি নির্মিত কুটিরের কোনওটাতেই বাতায়নের বালাই নেই।
বিস্ময়ভরা এই বিরাট পৃথিবীর কোনও বিস্ময়ই কিন্তু অন্তর স্পর্শ করেনি বৃদ্ধ অন্ধদের। চোদ্দো প্রজন্ম ধরে তারা যা জেনেছে, শিখেছে, বুঝেছে, নানেজের কথামালার সঙ্গে তার কিছুই মেলে না। তাই বিশ্বাস করেনি একবর্ণও। চোখ আর দৃষ্টি তাদের কাছে একেবারেই অজ্ঞাত। কান আর আঙুলের ডগা অতিশয় অনুভূতিসচেতন। নানেজের ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। তাই শিশু ঠাউরেছিল নানেজকে। অপরিণত মস্তিষ্ক আর অপ্রতুল জ্ঞান নিয়ে যখন এসেই পড়েছে জ্ঞানবৃদ্ধ অন্ধদের সামনে, তখন জ্ঞানদান করে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার ভরিয়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিল। এই দেশ আগে ছিল একটা পার্বত্য খোঁদলের মধ্যে। এই তাদের পৃথিবী। এর বাইরে আর কিছু নেই। প্রথম যারা এসেছিল এই নিরালা অঞ্চলে, স্পর্শ অনুভূতি ছিল না তাদের। তারপর জাগ্রত হল আশ্চর্য সেই অনুভূতি। জীবন আর ধর্ম সম্বন্ধে শিখল অনেক কিছুই। এখন এখানকার আকাশে গান গেয়ে বেড়ায় পরিরা, মাঠে চরে বেড়ায় লাম্যারা। লাম্যারা তাদের বশ মেনেছে, পরিদের কিন্তু স্পর্শও করা যায় না, শুধু কান পেতে শোনা যায়, তারা আছে, তারা আছে। শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল নানেজ। পরি? পরক্ষণেই বুঝেছিল, পাখিদের কথা বলা হচ্ছে। পাখিরাই এদের কাছে পরি!
প্রবীণতম অন্ধ দিনরাতের অদ্ভুত ব্যাখ্যা শুনিয়েছিল নানেজকে। অন্ধদের কাছে দিন মানে উষ্ণ সময়, রাত্রি মানে শীতল সময়। দুভাগে ভাগ করা দুটিমাত্র সময় ছাড়া দিনরাতের মাধুর্য তাদের অজানা। উষ্ণ সময়ে তারা ঘুমায়। শীতল সময়ে কাজ করে। এখন ঘুমানোর সময়, নানেজ কি ঘুমাবে? ঘুমাতে হয় কী করে, জানে তো? কথাবার্তা যার অসংলগ্ন, চলতে গেলে হোঁচট খায়, ঘুমাতে হয় কী করে, তা কি শিখিয়ে দিতে হবে?
নানেজ যেন কচি খোকা, দোলনার শিশু। অসীম সহানুভূতি ঝরে পড়েছিল বৃদ্ধদের কণ্ঠে।
নানেজ বলেছিল, ঘুমাতে সে জানে। ঘুমাবেও। তার আগে চাই খাবার। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে।
খাবার এনে দিয়েছিল অন্ধরা। নিরালায় বসে পেট ভরে খেয়েছিল নানেজ। কখনও হেসেছে, মজা পেয়েছে, আবার রাগও হয়েছে। দুগ্ধপোষ্য শিশু ভেবেছে তাকে। শিশুর মতোই নাকি মনবুদ্ধি, কথাবার্তা, চলাফেরা পেকে ওঠেনি। নির্বোধ কোথাকার! রাজা হতে যে এসেছে অন্ধদের দেশে, তার সম্বন্ধে কী চমৎকার ধারণা! সময় আসুক, বুদ্ধি আর জ্ঞান কাকে বলে, হাতেনাতে দেখিয়ে দেবে। হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে ছাড়বে।
অন্ধদের দেশে সবাই যখন ঘুমাচ্ছে, নানেজ তখন জেগে বসে। সাত-পাঁচ ভাবছে আর নানান ফন্দি আঁটছে। ভাবতে ভাবতেই বিকেল গড়িয়ে সূর্য অস্ত গেল।
সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য দেখে মনটা কানায় কানায় ভরে উঠেছিল নানেজের, তুষার প্রান্তর আর হিমবাহের ওপর গোধূলির বর্ণসুষমা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। বিপুল আবেগে প্রণত হয়েছিল ঈশ্বরের উদ্দেশে, যার আশীর্বাদে এই চক্ষুরত্ন ব্যবহার করে মহান সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছে সমস্ত হৃদয় দিয়ে।
গ্রাম থেকে একজন অন্ধ হাঁক দিয়ে ডেকেছিল তাকে।