নিশ্চুপ দেহে দাঁড়িয়ে ছিল তিনজন তার দিকে কান পেতে, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। কানই যেন তাদের চোখ। কান দিয়ে শুনে বুঝেছিল ওই পায়ের আওয়াজ তাদের একেবারেই অচেনা। তাই ভয় পেয়েছিল। পরস্পরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল তিনজনে। কাছ থেকে নানেজ দেখছিল। চোখের পাতা তাদের বন্ধ, অক্ষিকোটরে যেন চোখ ঢুকে রয়েছে, চক্ষুগোলক যেন হারিয়ে গেছে কোটরের মধ্যে। আতঙ্ক পরিস্ফুট তিনজনেরই মুখের পরতে পরতে।
ফিসফিস করে দুর্বোধ্য স্পেনীয় ভাষায় বলেছিল একজন, প্রেত অথবা মানুষ পাহাড় থেকে নেমে এসেছে—
নানেজের প্রতি পদক্ষেপে কিন্তু তখন যৌবনের সুগভীর আত্মপ্রত্যয়। মাথার মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছে চারণগীত–একচক্ষুও যেন রাজা অন্ধদের সেই দেশে। দৃষ্টিহীনদের আশ্চর্য দেশের অত্যাশ্চর্য সমস্ত গল্পই হুটোপুটি জুড়েছে মাথার মধ্যে।
একচক্ষুও যেন রাজা অন্ধদের সেই দেশে।
রাজার মতোই তাই বীরোচিত পদক্ষেপে, বুক উঁচিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিমায় অগ্রসর হয়েছিল নানেজ। সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল তিন চক্ষুহীনকে নিজের চক্ষুরত্নের পূর্ণ ব্যবহার করে।
ফিসফিস করে তিনজনের একজন বলে উঠেছিল, পেড্রো, কোত্থেকে এল বল তো?
পাহাড়ের ওপার থেকে।
পাহাড়ের ওপার থেকে বলেছিল নানেজ। এমন একটা দেশ থেকে, যে দেশের সবাই দেখতে পায়। বাগোটার কাছে আছে সেই দেশ, আছে হাজার হাজার মানুষ, বিরাট শহর, দৃষ্টি দিয়েও তার শেষ দেখা যায় না।
দৃষ্টি? বিড়বিড় করে উঠেছিল পেড্রো, দেখা?
নিম্নস্বরে বলেছিল দ্বিতীয় অন্ধ, পাহাড়ের বাইরে থেকে এসেছে।
নানেজ তখন খুঁটিয়ে দেখছিল তিনজনের পোশাক। অদ্ভুত ফ্যাশনের পোশাক। তিনজনের তিনরকম। সেলাই আর কাটছাঁটও তিনরকম।
চমকে উঠেছিল পরক্ষণেই। সামনে বিস্তৃত দুহাতের দশ আঙুল বাড়িয়ে একযোগে তিন অন্ধ এগিয়ে আসছে তাকে ধরতে। ঝটিতি নাগালের বাইরে সরে এসেছিল নানেজ, কিন্তু পালাতে পারেনি। পায়ের শব্দ শুনে ঠিক সেইদিকেই ছুটে গিয়ে নানেজকে কষে চেপে ধরেছিল তিনজনে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত হাত বুলিয়ে দেখে নিয়ে সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিল একজন, হুশিয়ার!
নানেজের চোখে আঙুল পড়তেই আঁতকে উঠেছিল অন্ধ মানুষটা। চোখের পাতা পড়ছে, চোখ নড়ছে! অদ্ভুত ব্যাপার তো! আবার হাত বুলিয়ে দেখেছিল পা থেকে মাথা পর্যন্ত। পেড্রো নামধারী অন্ধ বলেছিল, কোরিয়া, এ তো আচ্ছা সৃষ্টিছাড়া জীব! মাথার চুল লাম্যার মতো কড়া!
শুধু চুল নয়, গালও পাথরের মতো কর্কশ, নানেজের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলেছিল কোরিয়া, হাতও ভিজে ভিজে। পাহাড় থেকে এসেছে তো, পাহাড়ের মতোই নোংরা। পরে পরিষ্কার করে নেওয়া যাবেখন।
কথা চলছে, কিন্তু নানেজকে কেউ ছাড়ছে না, শক্ত মুঠিতে এমনভাবে ধরে রেখেছে যে পালানোর ক্ষমতাও নেই। ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে বুঝেছিল, চোখ না থাকতে পারে, এদের গায়ে জোর আছে বিলক্ষণ।
পেড্রো বলেছিল, ওহে, তুমি তো কথাও বল, মানুষ নিশ্চয়?
মানুষ তো বটেই, তোমাদেরই মতো মানুষ। তফাত শুধু এক জায়গায়–তোমাদের চোখ। নেই–আমার চোখ আছে–দেখবার ক্ষমতা আছে।
দেখবার ক্ষমতা! পেড্রো বিমূঢ়।
হ্যাঁ, তোমরা যে দেশের মানুষ, আমি এসেছি সে দেশের বাইরে থেকে। সে দেশ হিমবাহ পেরিয়ে, পাহাড় পেরিয়ে, অনেক দূরে, সূর্যের কাছাকাছি। সেখান থেকে সমুদ্র মোটে বারো দিনের পথ।
বৃথাই বকে গিয়েছিল নানেজ। দৃষ্টিশক্তির ক্ষমতা সম্বন্ধে কিসসু বোঝাতে পারেনি অন্ধদের। উলটে নানেজকে যখন টেনে নিয়ে যাচ্ছে প্রবীণদের কাছে, তখন কবলমুক্ত হতে গিয়েছিল গায়ের জোরে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মনে হয়? সে কি অন্ধ? রীতিমতো চক্ষুষ্মন। নিজেই পথ দেখে যেতে পারবে।
কিন্তু চোখ থাকা সত্ত্বেও হুমড়ি খেয়ে পড়ায় সহানুভূতিসচক মন্তব্য করেছিল একজন, বেচারা! বিচিত্র প্রাণীটার অনুভূতিগুলোও ভোঁতা, ত্রুটিপূর্ণ। নইলে এইভাবে হোঁচট খায়? কথাবার্তাও অসংলগ্ন, অর্থহীন প্রলাপ। হাত ধরে নিয়ে চল হে, নইলে মুখ থুবড়ে পড়বে।
বেদম হাসি পেয়েছিল নানেজের। আর বাধা দেয়নি৷ লাভ কী? দৃষ্টিশক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান যাদের নিতান্তই অপ্রতুল, তাদের সঙ্গে চোখ নিয়ে কথা বলাটাও আহাম্মুকি। পরে শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া যাবেখন।
অন্ধ তিনজনে হাঁকার দিয়ে সজাগ করে দিয়েছিল সবাইকে। আজব চিড়িয়া এসেছে তাদের দেশে, বাচ্চাকাচ্চারা যেন তার সান্নিধ্যে আঁতকে না ওঠে। নানেজের কানে ভেসে এসেছিল বহু ব্যক্তির চেঁচামেচি, দেখেছিল, গ্রামের মধ্যিখানের পথে জড়ো হচ্ছে কাতারে কাতারে মানুষ। কাছাকাছি হতেই হেঁকে ধরেছিল নানেজকে। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝতে চেয়েছিল আজব চিড়িয়াটা কী ধরনের। কেউ কেউ ভয়ে কাছে আসেনি। কিন্তু কান খাড়া করে শুনেছে নানেজের প্রতিটি কথা। ওর চড়া, কর্কশ কণ্ঠস্বর যে মোটেই শ্রুতিমধুর নয়, অন্ধদের সংবেদনশীল কর্ণকুহরে অত্যাচার সৃষ্টি করে চলেছে–মুখের ভাব দেখে তা অনুমান করেছে নানেজ। শুধু কানের পরদা নয়, অন্ধ মানুষদের সবকিছুই কোমল এবং তীব্র মাত্রায় অনুভূতিসচেতন। হাত নরম, মুখের ভাবও স্নিগ্ধ সুন্দর। কয়েকজনকে দেখতে মিষ্টি ফুলের মতোই। শুধু যা চোখ নেই কারওই, চোখের গর্তে অক্ষিগোলক হারিয়ে গেছে চিরতরে। পথপ্রদর্শক অন্ধ তিনজন আগাগোড়া আগলে রেখেছিল তাকে, নানেজ যেন তাদেরই একার সম্পত্তি, পাহাড় থেকে খসে-পড়া বিচিত্র জীবটার একমাত্র স্বত্বাধিকারী।