হাজার ফুট গড়িয়ে এসেছিল চক্ষের নিমেষে। তার পরেও হাজারখানেক ফুট পিছলে গিয়েছিল পতনের বেগে আরও খাড়াই ঢাল বেয়ে। তুষার সেখানে আরও পুরু। পাকসাট খেতে খেতে আচমকা এইভাবে গড়িয়ে পড়ার ফলে মাথা ঘুরে গিয়েছিল, চৈতন্য লোপ পেয়েছিল, কিন্তু একটা হাড়ও ভাঙেনি নরম তুষার গদির ওপর পিছলে যাওয়ার দরুন– খাড়াই ঢাল আর ততটা খাড়াই থাকেনি–আস্তে আস্তে মন্দীভূত হয়েছে পতনের বেগ, নরম তুষারস্থূপে আলতোভাবে আছড়ে পড়ায় বেঁচে যায় প্রাণটা। জ্ঞান ফিরে আসার পর মনে হয়েছিল, বুঝি বা অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে আছে কোমল শয্যায়। কিন্তু অচিরেই পর্বতারোহীর উপস্থিতবুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করেছিল পরিস্থিতির গুরুত্ব। তুষার-গদির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিল আকাশের অগুনতি তারার পানে চেয়ে। হাড়গোড় একটাও ভাঙেনি। শুধু যা কোটের সব কটা বোতাম ছিঁড়ে গেছে। পকেট থেকে ছুরিটাও পড়ে গেছে। থুতনির সঙ্গে বাঁধা টুপিটাও নিপাত্তা। একটু একটু করে মনে পড়েছিল, পাথর খুঁজছিল আস্তানা বানাবে বলে। পা পিছলেছে তখনই। বরফ-কুঠারও ছিটকে গেছে হাত থেকে।
তখন চাঁদ উঠেছে। আকাশছোঁয়া পাহাড়ের ঢাল দেখে বুঝেছিল, আচমকা পা পিছলে গিয়ে সটান নেমে আসার ফলেই মাথা ঘুরে গিয়েছিল, চেঁচাতেও পারেনি।
পায়ের তলায় কিছু দূরে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট ঝোপ। তুষারপ থেকে পা টিপে টিপে নেমে গিয়েছিল সেখানে। ফ্লাস্কের জল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল একটা গোলাকার স্থলিত শিলার পাশে।
ঘুম ভেঙেছিল পাখির গানে। ঐকতান শোনা যাচ্ছে মাথার ওপর।
খাড়াই পাহাড়ের পর পাহাড় উঠে গেছে যেন আকাশ পর্যন্ত। পূর্ব আর পশ্চিমে প্রাচীরের মতো পাহাড়। রৌদ্রালোকে প্রদীপ্ত।
পায়ের তলায় ঢাল বেয়ে কিন্তু নামা যায়। চিমনির মতো একটা ফাঁক বরাবর ঝরনার জল গড়িয়ে যাচ্ছে। সন্তর্পণে সেইখান দিয়ে কিছুটা নেমে আসার পর বহু দূরে উপত্যকার মধ্যে দেখেছিল কয়েকটা প্রস্তর-কুটির।
জঙ্গল পড়েছিল নামবার পথে। পেরিয়ে এসেছিল হুশিয়ার চরণে।
দুপুর নাগাদ পৌঁছেছিল গিরিবর্ক্সের তলদেশে। পাহাড়ি ঝরনার জল পান করে, একটু জিরিয়ে নিয়ে রওনা হয়েছিল প্রস্তর-কুটিরগুলোর দিকে।
পুরো উপত্যকাটাই মনে হয়েছিল কেমন যেন অদ্ভুত। বাড়িগুলোর চেহারাও সৃষ্টিছাড়া। বিভিন্ন রঙের পাথর দিয়ে তৈরি। কখনও ধূসর পাথর, কখনও উজ্জ্বল। অত্যন্ত বেমানানভাবে অজস্র রঙের পাথর দিয়ে প্রস্তর-কুটির নির্মাণ করেছে যারা, তারা যেন চোখের ব্যবহার করতেও জানে না। অন্ধ নাকি? অন্ধ শব্দটা সেই প্রথম তার মাথায় এসেছিল শুধু এই বর্ণবৈষম্য দেখে।
অথচ বৈষম্য নেই আর কোথাও। নিখুঁত পারিপাট্য বিরাজমান সর্বত্র। বহু উঁচুতে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাম্যার দল। পাহাড়ি ঝরনার জল সঞ্চিত হচ্ছে একটা বিশাল উঁচু প্রাচীরের মতো পরিখায়। জ্যামিতিক ছকে সাজানো বিস্তর কৃষিক্ষেত্রে জলসিঞ্চনের ব্যবস্থা রয়েছে। এই পরিখা থেকে। নিয়মিত ব্যবধানে বহু পাথর বাঁধাই পথ বেরিয়েছে মূল পরিখা থেকে। একটা চওড়া নালা নেমে এসেছে, নালার দুপাশে বুকসমান উঁচু পাঁচিল। কুটিরগুলোও নিয়মিত ব্যবধানে নির্মিত পথের দুপাশে, পথটিও আশ্চর্যভাবে পরিষ্কার। পাহাড়ি গ্রামের কুটির ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, এখানে তা নয়।
আরও একটু নেমে এসেছিল নানেজ। উপত্যকা ঘিরে-থাকা পাঁচিল আর পরিখার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল, নালার বাড়তি জল জলপ্রপাতের আকারে ঝরে পড়ছে উপত্যকার এক প্রান্তে একটা গভীর খাদের মধ্যে। পুরো উপত্যকার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে নালাটা, প্রতিটি জমিতে জলসিঞ্চনের অপূর্ব ব্যবস্থা দেখে অবাক না হয়ে পারেনি। দূরে স্তূপীকৃত ঘাসের ওপর যেন দিবানিদ্রা দিচ্ছে কয়েকজন নারী এবং পুরুষ। প্রান্তরের অপরদিকে কুটিরগুলোর সামনে খেলা করছে কয়েকটি শিশু। কাছেই, উঁচু পাঁচিল বরাবর পথ বেয়ে কুটির সারির দিকে অগ্রসর হচ্ছে তিনজন পুরুষ। জলপাত্র বয়ে নিয়ে চলেছে জোয়ালের ওপর। খুব কাছে রয়েছে বলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ। পায়ের বুটও লাম্যার চামড়ায় তৈরি। কান আর কাঁধ-ঢাকা টুপি রয়েছে মাথায়। চলেছে একজনের পেছনে আর-একজন। যাচ্ছে আর হাই তুলছে, যেন সারারাত কেউ ঘুমায়নি। হাবভাব দেখে সম্ভ্রমবোধ জাগে, সমৃদ্ধির ছাপ যেন পা থেকে মাথা পর্যন্ত। মনে সাহস পায় নানেজ। আরও একটু এগিয়ে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচিয়েছিল তারস্বরে। প্রতিধ্বনির পর প্রতিধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিল নিবিড় প্রশান্তির নিকেতন সেই উপত্যকা।
থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল লোক তিনটে। পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করে দৃষ্টি আকর্ষণ করার অনেক চেষ্টা করেছিল নানেজ। কিন্তু তিনজনের কেউই যেন তাকে দেখতে পায়নি। এদিক-ওদিক মাথা ঘুরিয়েছে অন্ধের মতো। তারপর ডানদিকে মুখ ঘুরিয়ে সাড়া দিয়েছিল জোর গলায়।
অন্ধ নাকি? ফের মনে মনে বলেছিল নানেজ।
বেশ কিছুক্ষণ চেঁচা- মেচি করার পর রেগে মেগে পাথর থেকে নেমে এসেছিল নানেজ। ছোট্ট স্রোতস্বিনীটা পেরিয়ে এসেছিল সাঁকোর ওপর দিয়ে। পাঁচিলের ছোট দরজা দিয়ে ঢুকেছিল ভেতরে। গটগট করে এগিয়ে গিয়েছিল তোক তিনটের দিকে। তিনজনেই যে অন্ধ, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহই ছিল না মনে। অনেকদিন ধরেই শুনে আসছিল, অন্ধদের দেশ আছে দুর্গম পাহাড়ের কোলে। তখন মনে হয়েছিল অলীক উপকথা। বিশ্বাস করতে মন চায়নি। এখন তো স্বচক্ষে দেখছে সেই দেশ। অন্ধদের দেশে মস্ত অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পেয়ে বসেছিল নানেজকে। দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়েছিল দুই চক্ষুর অধিকারী মানুষটা চক্ষুহীন তিনজনের দিকে।