কিন্তু অতৃপ্তি ছিল কেবল একটি ব্যাপারে। দেবতার উপাসনা মন্দির ছিল না একটিও। তাই যখন অব্যাখ্যাত সংক্রমণে দৃষ্টিশক্তি হারাতে লাগল একে একে অনেকেই, এমনকী দৃষ্টিহীন হয়ে ভূমিষ্ঠ হল বহু নবজাতক, তখন একজন–শুধু একজনই–মন্দির প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে ছিটকে এসেছিল অভিশপ্ত অথচ অপরূপ সেই উপত্যকা থেকে। সে সময়ে সংক্রমণ কী বস্তু তা কেউ বুঝত না। দৃষ্টিহীনতার কারণ নিশ্চয় দেবতার অভিশাপ বদ্ধমূল এই ধারণা নিয়ে সে চলে এসেছিল একখণ্ড রুপোর বাট পোশাকের ভেতরে লুকিয়ে। কোথায় পেয়েছিল এই রজতখণ্ড, তা কিন্তু অনভিজ্ঞ মিথুকের মতো বর্ণনা করতে গিয়ে কৌতূহলই জাগ্রত করেছিল প্রত্যেকের অন্তরে। মূল্যবান এই ধাতু নিশ্চয় অঢেল পাওয়া যায় সেখানে কিন্তু মুদ্রার অথবা অলংকারের প্রয়োজন নেই বলে হেলায় পড়ে থাকে। ক্ষীণদৃষ্টি, রৌদ্রদগ্ধ, শীর্ণকায় যুবকটি সাগ্রহে পুরুতদের কাছে আবেদন জানিয়েছিল, দেবতার অধিষ্ঠান যেন ঘটে অভিশপ্ত উপত্যকায়। নইলে যে অন্ধ হয়ে যাবে সকলেই।
কিংবদন্তির শুরু সেই থেকেই। বহু দূরে… সুদূর উপত্যকায় বসবাস করে অন্ধ মানুষের একটা প্রজাতি।
আজও শোনা যায় সেই কিংবদন্তি।
পর্বতবেষ্টিত বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, মুষ্টিমেয় মানুষগুলির মধ্যে কিন্তু দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল বিচিত্র ব্যাধি। প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রবীণরা, ক্ষীণদৃষ্টি হয়ে এসেছিল নবীনরা, দৃষ্টিহীন হয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল শিশুরা।
জীবনের ধারা কিন্তু বয়ে গিয়েছিল নিরবচ্ছিন্ন গতিতে। যেখানে কাঁটাঝোপ নেই, কীটপতঙ্গের উপদ্রব নেই, হিংস্র শ্বাপদের হামলা নেই–যেখানে শান্ত-প্রকৃতি লাম্যা বিচরণ করে দলে দলে, সমীরণ বয় মৃদুমন্দ বেগে, ঝরনা ঝরে পড়ে অবিরাম, অন্ধ হয়েও সেখানে কারও জীবনে যতি পড়েনি। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে হতে লোপ পেয়েছিল এত ধীরে যে, ক্ষতিটাকে ক্ষতি বলে কেউ মনেও করেনি। অল্প দৃষ্টি নিয়েও সর্বত্র বিচরণ করে নখদর্পণে রেখেছিল পুরো উপত্যকাকে। তারপর যখন একেবারেই লোপ পেল দৃষ্টিশক্তি, বহাল তবিয়তে টিকে গেল পুরো প্রজাতিটা। পাথরের উনুনে আগুনও জ্বালাত চোখ না থাকা সত্ত্বেও। শিক্ষাদীক্ষা ছিল না বললেই চলে। অক্ষরপরিচয় ঘটেনি কোনওদিনই। স্পেনীয় সভ্যতার ছিটেফোঁটা, সুপ্রাচীন পেরু সংস্কৃতি আর লুপ্ত দর্শন–এই ছিল তাদের একমাত্র কৃষ্টি। অতিবাহিত হয়েছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম। বিস্মৃত হয়েছিল অনেক কিছুই, উদ্ভাবনও করেছিল অনেক কিছু অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল বহির্জগতের বর্ণোজ্জ্বল সংস্কৃতি। কিন্তু নিটোল ছিল স্বাস্থ্য, অফুরন্ত ছিল দৈহিক শক্তি হারিয়েছিল কেবল চক্ষু প্রত্যঙ্গ। পুরানো দিনের কাহিনি মুছে গিয়েছিল এক প্রজন্মে। এইভাবেই কেটে গিয়েছিল পরপর পনেরোটি প্রজন্ম–রজতখণ্ড বুকে নিয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ অন্বেষণে উপত্যকার বাইরে গিয়েছিল যে যুবকটি, সে কিন্তু আর ফিরে আসেনি। দীর্ঘ পনেরোটি প্রজন্মের পর তার কথাও কারও স্মৃতিপটে বিরাজমান থাকার কথা নয়। তারপর আশ্চর্য সেই উপত্যকায় বাইরের দুনিয়া থেকে অকস্মাৎ আবির্ভূত হল যে মানুষটি, নাম তার নানেজ। এ কাহিনি শুনেছি তারই মুখে।
কুইটোর কাছে একটা গ্রামনিবাসী পর্বতারোহী সে। বই-পড়া বিদ্যে ছাড়াও সমুদ্রপথে দেখেছে এই পৃথিবীটাকে। ইংরেজদের একটি পর্বত অভিযাত্রীদলে তার ঠাই হয়েছিল তিনজন সুইস পথপ্রদর্শক অসুস্থ হয়ে পড়ায়। ইকুয়েডরে এসেছিল তারা পর্বতারোহণের অভিপ্রায়ে। বিশেষ একটি উচ্চশিখর জয় করতে গিয়ে একদিন নিখোঁজ হয় নানেজ। তুষার-ছাওয়া শিখরের কিছু নিচেই তাঁবু পেতে অনেক হাঁকডাক এবং বাঁশি বাজিয়েও আর তার সাড়া পাওয়া যায়নি। ঘটনার বিবরণ প্রায় বারোবার প্রকাশিত হয়েছে। পয়েন্টারের বিবরণটাই সবচেয়ে নাটকীয় এবং বিশদ।
বিনিদ্র রজনি যাপনের পর সকালবেলা তারা দেখেছিল পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার বহু চিহ্ন। নিশ্চয় আর্ত-চিৎকার করেছিল নানেজ গড়িয়ে পড়ার সময়। কিন্তু কেউ তা শোনেনি –এটাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার। অথবা হয়তো গলা ফাটিয়ে চেঁচাবার সুযোগও পায়নি। পা পিছলে পড়েছে পাহাড়ের পূর্বদিকে–যেদিকটার কোনও খবরই রাখে না অভিযাত্রীরা। তুষারের বুক কেটে লাঙল চষার মতো পতনচিহ্ন অতিশয় সুস্পষ্ট, বুক-কাঁপানো খাড়াই ঢাল বেয়ে সটান গড়িয়ে গেছে বলেই চেঁচাবার ফুরসতও পায়নি। তারপর আর কিছুই চোখে পড়েনি। অনেক, অনেক নিচে দেখা গেছে কেবল সারি সারি মহীরুহ। অস্পষ্ট ধোঁয়ার মতো, একটা বদ্ধ উপত্যকা ঘিরে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে এক নিবিড় অরণ্য, অন্ধদের হারিয়ে-যাওয়া দেশ। অভিযাত্রীরা কিন্তু জানত না, এই সেই কিংবদন্তির দেশ, অন্ধদের উপত্যকা। এরকম উপত্যকা আরও রয়েছে দুর্গম এই পাহাড়ি অঞ্চলে। দুর্ঘটনাটা কিন্তু তাদের নার্ভাস করে দেয়। বিকেলের দিকে অভিযান মুলতুবি রেখে নেমে আসে পাহাড় থেকে। তারপরেই যুদ্ধে যেতে হয় পয়েন্টারকে। আজও পার্সকোটোপেটল শিখর কেউ জয় করতে পারেননি। আজও শিখরের ঠিক নিচেই পয়েন্টারের ঘাঁটি তুষারাবৃত হয়ে পড়ে আছে।
পাহাড় থেকে পড়ে-যাওয়া মানুষটা কিন্তু মরেনি-প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল স্রেফ আয়ু ছিল বলে।