তারপর একটা একটা করে রক্তচোষা শেকড় ছিঁড়েছিল গা থেকে। মিনিটখানেকের মধ্যেই শেকড়মুক্ত দেহটাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মূর্তিমান বিভীষিকার নাগালের বাইরে।
দেখেছিল, ডজনখানেক চাকা চাকা দগদগে ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে ভাইয়ের থুতনি, ঘাড় আর গলা বেয়ে। সমস্ত দেহটা যেন রক্তশূন্য–সাদা! ঠিক এই সময়ে ঠিকে কাজের লোকটা বাগানে ঢুকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ভাঙা কাচ আর ওয়েদারবানের রক্ত মাখা অসাড় দেহ দেখে। তাকে দিয়েই জল আনিয়েছিল বোন। ফোঁপাতে ফোঁপাতে রক্ত মুছে দিয়েছিল ভাইয়ের মুখ থেকে। ব্যাপার কী? চোখ খুলেই ফের বন্ধ করে ফেলে ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিল ওয়েদারবার্ন।
লোকটাকে ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছিল বোন। ইতিমধ্যে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল ভাই–একটু পরেই ফের জ্ঞান ফিরে পেয়ে চি-চি করে জানতে চেয়েছিল, ব্যাপারটা কী? এভাবে বাগানের মধ্যে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে কেন? বোনই বা কাঁদছে কেন?
হট-হাউসে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে তুমি।
অর্কিডটা?
তার ব্যবস্থা আমি করছি।
ডাক্তার এসে ওয়েদারবার্নকে নিয়ে গেল ওপরতলায়। ব্র্যান্ডি আর মাংসের স্যুপ খাইয়ে তাকে চাঙ্গা করার পর বোন এল হট-হাউসে–সঙ্গে নিয়ে এল ডাক্তারকে।
ভাঙা জানলা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে কড়া এবং ভয়ানক মিষ্টি সেই গন্ধকে প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছে বললেই চলে। ছেঁড়া শেকড়গুলো যেখানে যেখানে পড়ে, সেইসব জায়গায় ইটের ওপর জমাট কালো রক্ত। বেঞ্চি থেকে টব উলটে পড়ায় ডাঁটি ভেঙে গেছে অর্কিড চারার। নেতিয়ে পড়েছে ফুল তিনটে। বাদামী হয়ে আসছে পাপড়ির কিনারা। সেইদিকে এক পা এগিয়েছিল ডাক্তার। কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল একটা বাতাসে মেলে-ধরা শেকড়কে তখনও থিরথির করে কাঁপতে দেখে।
পরের দিন ভোরবেলা দেখা গেল, মেঝের ওপরেই পড়ে আছে অদ্ভুত অর্কিড। বিবর্ণ কালচে। পচন ধরেছে। হাওয়ায় দমাদম করে আছড়ে পড়ছে দরজা। শিউরে শিউরে উঠছে ওয়েদারবার্নের বিপুল অর্কিড-সংগ্রহ।
আর ওয়েদারবান? অতগুলো ক্ষতমুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় কাহিল হয়ে পড়েছিল খুবই-তার বেশি কিছু নয়। বহাল তবিয়তে শুয়ে ছিল ওপরতলায়। মনে খুব ফুর্তি–অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চারের প্রসাদে বুক দশ হাত!
অন্ধ যে দেশে সকলেই
অন্ধ যে দেশে সকলেই ( The Country of the Blind )
[‘The Country of the Blind’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Strand Magazine’ পত্রিকায় এপ্রিল ১৯০৪ সালে। পরে ‘Thomas Nelson and Sons’ থেকে ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘The Country of the Blind and Other Stories’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। পরে ওয়েলস গল্পটি মার্জনা করেন এবং ১৯৩৯ সালে নতুন করে ‘Golden Cockerel Press’ থেকে বের করেন।]
রহস্যময় পার্বত্য উপত্যকায় আছে অন্ধদের দেশ। আশ্চর্য সেই দেশে অন্ধ প্রত্যেকেই। চক্ষুম্মানের ঠাঁই নেই সেখানে। লোমহর্ষক এই কাহিনি শোনা গিয়েছিল একজনেরই মখে, দৈবাৎ পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে পৌঁছেছিল সেই দেশে, চক্ষুরত্ন সম্বল করে পালিয়ে এসেছিল কোনওমতে।
অনেক… অনেক দূরের পথ সেই পার্বত্য উপত্যকা। শিমবোরাজো থেকে সাড়ে তিনশো মাইলেরও বেশি, কোটোপাক্সির তুষার-ছাওয়া অঞ্চল থেকে শখানেক মাইল তো বটেই। ইকুয়েডর্স অ্যান্ডিজের ধু ধু ঊষর অঞ্চলে রয়েছে সেই অবিশ্বাস্য দেশ–যে দেশে অন্ধ সকলেই।
বহু বছর আগে কিন্তু পাহাড়-পর্বত টপকে, গিরিবর্ক্সের মধ্যে দিয়ে যাওয়া যেত সেই উপত্যকায়। অত্যাচারী স্পেনীয় শাসকের খপ্পর থেকে পালিয়ে কয়েকটি পেরুভিয়ান দোআঁশলা পরিবার পৌঁছেছিল সেখানে।
তারপরেই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় শুরু হল মিনডোবাম্বায়, সতেরো দিন নিশীথ রজনিতে আবৃত রইল কুইটো, জল ফুটতে লাগল আগুয়াচিতে, গুয়ায়াকুইল দিয়ে ভেসে গেল অগুনতি মরা মাছ। প্রশান্ত মহাসাগরের পাহাড়ি ঢাল বরাবর ধস, অকস্মাৎ জলপ্লাবন, আরাউকা শিখরের ধসন বজ্ৰধনির মধ্যে দিয়ে চিরতরে রুদ্ধ করে দিলে অন্ধদের দেশে প্রবেশের যাবতীয় পথ। দুনিয়া যখন এইভাবে প্রকম্পিত, তার আগেই একজন… শুধু একজন ছিটকে এসেছিল বহির্জগতে… রহস্যময় পার্বত্য উপত্যকায় থেকে গিয়েছিল তার স্ত্রী আর ছেলে। বাইরের দুনিয়ায় নতুন করে সে জীবন শুরু করে। কিন্তু স্বাস্থ্যভঙ্গ ঘটে অচিরেই, অন্ধত্ব ছিনিয়ে নেয় চোখের দৃষ্টি, খনি অঞ্চলে অসীম শাস্তিভোগের পর একদিন রওনা হয় পরলোকের পথে। কিন্তু যে কাহিনি সে শুনিয়ে গিয়েছিল, তা আজও কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে অ্যান্ডিজের করডিলারাসে।
দক্ষিণ আমেরিকায় উটের মতো একরকম জন্তু দেখা যায়। কিন্তু উটের চাইতে ছোট এবং পিঠে কুঁজ নেই। নাম, লাম্যা। শৈশবে এই লামার পিঠে মালপত্র সমেত তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সুদুরের সেই উপত্যকায়। নয়নাভিরাম সেই উপত্যকায় মানুষ যা পেলে সুখী হয়, শান্তি পায়, তার সবই আছে। আছে গাছে গাছে ফল, সুপেয় জল, কৃষিক্ষেত্র, মনোরম আবহাওয়া, উর্বর বাদামি মৃত্তিকা, তুষার পর্বতের গায়ে নিবিড় অরণ্য। তিনদিকে ধূসর সবুজ পাহাড় উঠে গেছে যেন আকাশ অবধি-চিরতুষারে ঢাকা তাদের কিরীট। হিমবাহ নদী কিন্তু উপত্যকায় না এসে বয়ে যায় পাহাড়ের অন্যদিকের ঢাল বরাবর। মাঝে মাঝে বরফের চাঙড় খসে পড়ে উপত্যকায়। বৃষ্টি হয় না সেখানে, তুষারপাতও ঘটে না। স্থির পাহাড়ি ঝরনার জলে বারো মাস সবুজ থাকে চাষের জমি, প্রান্তর, তৃণভূমি। মানুষজনের কোনও চাহিদা অপূরণ থাকে না সেখানে, সুখী সেখানকার প্রতিটি পশুপক্ষী।