বলে, সোজা আমার দিকে চেয়ে রইল সে।
আমি বললাম, দেখুন মশায়, এই পরিস্থিতিতে একখানা হীরে কেনাও আমরা পক্ষে বাতুলতা। সবচেয়ে বড় অসুবিধে, পকেটের মধ্যে হাজার হাজার পাউন্ড নিয়ে রাস্তায় ঘোরার মতো বড়লোক আমি নই। তবে হ্যাঁ, আপনার কথা একেবারে অবিশ্বাস করতে পারছি না। এক কাজ করতে পারেন। কাল আসুন আমার অফিসে।
ধারালো গলায় তক্ষুনি বললে সে, চোর ঠাওরেছেন মনে হচ্ছে আমাকে? খবর দিয়ে রাখবেন পুলিশকে? না মশাই, ফাঁদে পা দিতে চাই না।
না, না, চোরাই মাল নয়। চোর আপনি নন, এ বিশ্বাসটা যেভাবেই হোক, এসে গেছে। মনের মধ্যে। তাহলে বরং যখন খুশি আসুন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করার দরকার নেই।
আমার কার্ড দিলাম, সেই সঙ্গে একটা আধ ক্রাউন।
বললাম, রাখুন, কাজে লাগবে।
সুদ সমেত ফিরিয়ে দেব দেনা। ঋণী থাকব না, এইটুকু শুধু বলে রাখলাম। সুদের পরিমাণটা শুনলে কিন্তু চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। যাক গে সে কথা, যা বললাম, তা পাঁচকান করবেন না আশা করি?
জবাবের জন্যে দাঁড়িয়ে না থেকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল হীরে কারিগর। দেখলাম, এসেক্স স্ট্রিটের দিকে তার ছায়ামূর্তি হেঁটে যাচ্ছে হনহন করে। বাধা দিলাম না। আর তাকে দেখিনি।
দুটো চিঠি পেয়েছিলাম পরে। ব্যাঙ্ক নোট পাঠাতে বলেছে বিশেষ একটা ঠিকানায়–চেক হলে চলবে না। ভেবেচিন্তে হঠকারিতার মধ্যে পা বাড়ানো সমীচীন বোধ করলাম না। একবার সে দেখা করতেও এসেছিল। আমি তখন ছিলাম না। চিনতে পেরেছিলাম চেহারার বর্ণনা শুনে। দারুণ রোগা, নোংরা, ছেঁড়া জামাকাপড়-পরা দর্শনার্থীর চোখ-নাক ঠেলে বেরিয়ে আসছিল ভয়াবহ কাশির দমকে। চিঠিপত্র লিখে রেখে যায়নি, আমি নেই শুনেই চলে গেছে। সেই শেষ, এ কাহিনিতে আর তার আবির্ভাব ঘটেনি। জানি না সে সত্যই হীরে কারিগর, না নুড়ি জালিয়াতিতে পোক্ত। বদ্ধ উন্মাদ হওয়াও বিচিত্র নয়। মাঝেমধ্যে কিন্তু মনে হয়, হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলেছি। এমন সুযোগ জীবনে দুবার আসে না। কে জানে, এদ্দিনে হয়তো তার প্রাণপাখি উড়ে গেছে জীর্ণ খাঁচা ছেড়ে। নুড়ির মতো দেখতে হীরেগুলোকেও থলি সমেত টান মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে জঞ্জালের গাদায়। থলির মধ্যেকার একটা হীরের সাইজ কিন্তু আমার এই মোটাসোটা বুড়ো আঙুলের মতো বিরাট। নিজের চোখে দেখা, হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করা। এমনও হতে পারে, আজও সে হীরের বেসাতি করে বেড়াচ্ছে, খদ্দের খুঁজে যাচ্ছে বৃথাই। কেউ কর্ণপাতও করছে না অথবা হয়তো টাকার পাহাড়ে চড়ে বসেছে এদ্দিনে। মাতব্বর হয়েছে, কিন্তু টাকার বান্ডিলের দৌলতেই ভিড়ে গেছে কোটিপতিদের মেঘালয়ে, সাধারণ মানুষ খবর রাখে না সেই উচ্চমার্গের, নাগাল পাওয়া তো দূরের কথা, তাই আমি তার কোনও খবর না রাখলেও আমার খবর রাখে সে। মুচকি হাসি হাসে আমার দুরবস্থা দেখে। ঝুঁকি নিতে পারিনি সেদিন, মাত্র পাঁচ পাউন্ড যদি বার করতে পারতাম, আজ আমার টাকা খায় কে! দূর থেকে আজও হয়তো সে নীরবে ভর্ৎসনা করে চলেছে আমার এই অবিবেচক সত্তাটাকে।