চোখ তুলে বললাম, হীরে বলেই তো মনে হচ্ছে। হীরেই যদি হয়, তাহলে বলব রাজা হীরে। পেলেন কোথায়?
বললাম তো, নিজে বানিয়েছি। দিন, আর দেখতে হবে না। এস্তে অদ্ভুত হীরেটাকে থলিতে পাচার করে কোটের বোতাম এঁটে দিল হীরে কারখানার মালিক। পরক্ষণেই বললে ব্যগ্র চাপা কণ্ঠে, একশো পাউন্ড পেলেই বেচে দেব, এখুনি।
শুনেই আবার ফিরে এল মনের সন্দেহ। কে জানে, হীরের মতো দেখতে হলেও জিনিসটা আসলে হয়তো একতাল কোরানডাম ছাড়া আর কিছুই নয়। হীরের মতোই প্রায় কঠিন বস্তু এই কোরানডাম দিয়ে হীরেপ্রেমিকদের ঠকানোর কত কাহিনি শুনেছি। কোরানডাম যদি না-ও হয়, সাচ্চা হীরে কেউ মাত্র একশো পাউন্ডে বেচে? তা ছাড়া পেল্লায় এই হীরে এই হাঘরেটার কাছে এল কীভাবে?
নির্নিমেষে চেয়ে রইলাম তার চোখের দিকে। দেখলাম, নির্ভেজাল ব্যগ্রতার রোশনাই হীরের মতোই ঝকমক করছে চোখে। জহুরি যেমন জহর চেনে, আমিও তেমনি ওই চাহনি দেখে নিমেষে বুঝলাম জোচ্চোর নয়, রাতের ভবঘুরে, খাঁটি হীরেই বেচতে চায়। কিন্তু কেনবার মতো পয়সা কই পকেটে? গরিব মানুষ আমি। একশো পাউন্ড বার করে পথে বসব নাকি? তা ছাড়া গ্যাস লাইটের আলোয় ছেঁড়া ময়লা জামাকাপড় পরা এক হাঘরের কাছ থেকে এত দামি হীরে কেউ কেনে? শুধু মুখের কথায় বিশ্বাস করে?
অথচ, খাঁটি হীরেই দেখলাম এইমাত্র। কয়েক হাজার পাউন্ড দাম হওয়া উচিত। তা-ই যদি হয়, কোনও রত্ন-পুস্তকে পেল্লায় সাইজের এই হীরের কথা তো চোখে পড়েনি আমার। কেন? আবার জাল হীরের রাশি রাশি গল্প ভিড় করে এল মাথার মধ্যে। হীরে কেনার চিন্তা শিকেয় তুলে রাখলাম তৎক্ষণাৎ।
শুধালাম, পেলেন কোথায় এ জিনিস?
বানিয়েছি।
নকল হীরে একজনই বানায়। তার নাম জানি। সে হীরেও আমি দেখেছি। কিন্তু তা অনেক ছোট, এত বিরাট নয়। মাথা ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দিলাম, কথাটা বিশ্বাস হয়নি আমার।
স্থির চোখে সে দেখছিল আমার মুখের চিন্তা। এখন বললে, হীরের খবর অনেক রাখেন মনে হচ্ছে। আমার খবরটাও তাহলে শুনে রাখুন। শুনলে হয়তো কেনবার সাধ হবে। নদীর দিকে পিঠ ফিরিয়ে পকেটে দুহাত পুরে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাতের আগন্তুক, শোনবার পরেও যে আপনার বিশ্বাস হবে না একবর্ণও, তা জেনেও সব বলব আপনাকে।
একটু বিরতি দিয়ে আত্মকথা শুরু করেছিল মূর্তিমান রহস্য সেই অচেনা মানুষটা। সঙ্গে সঙ্গে পালটে গিয়েছিল কণ্ঠস্বর। এতক্ষণ গলার আওয়াজে ক্ষীণভাবে জড়িয়ে ছিল হাঘরেদের অমার্জিত সুর। এখন মনে হল যেন শিক্ষিত মানুষ কথা বলে যাচ্ছে মেপে মেপে–শব্দচয়ন এবং উচ্চারণের মধ্যে বৈদগ্ধ্য আর পাণ্ডিত্য উজ্জল হীরকের মতোই দ্যুতি বিকিরণ করে চলেছে।
সঠিক উপাদানের মিশ্রণ-প্রবাহে কার্বন ছিটিয়ে দিয়ে সঠিক চাপ সৃষ্টি করতে পারলেই হীরে তৈরি করা যায়। কার্বন বেরিয়ে আসে ক্রিস্টালের আকারে-কালো সিসে বা কাঠকয়লা গুঁডোর আকারে নয়, ছোট ছোট হীরের আকারে। বহু বছর ধরে এইটুকুই জেনে এসেছে কেমিস্টরা। মিশ্রণ-প্রবাহের সঠিক উপাদান কী হওয়া উচিত, কতখানি চাপ দেওয়া উচিত উক্তৃষ্ট হীরে বানানোর জন্যে, তা কিন্তু কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি, তাই কেমিস্টদের হাতে বানানো হীরে জহুরির কাছে দাম পায়নি, গয়নায় তার ঠাঁই হয়নি… পুঁচকে, কালচে কার্বনের ডেলার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। সেরা হীরে তৈরির এই মূল রহস্যটা নিয়ে আমি কিন্তু প্রাণপাত পরিশ্রম করে গেছি সারাজীবন। জীবনটাকেই ব্যয় করছি বলতে পারেন এর পেছনে।
কাজ শুরু করেছিলাম সতেরো বছর বয়সে। এখন আমার বয়স বত্রিশ। তখন মনে হয়েছিল দশ-বিশ বছরের মেহনত কিছুই নয়। মনের ভাবনাকে কাজে রূপ দেওয়াটাই একমাত্র ধ্যানধারণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, এত মেহনতের দাম একখানা মোমবাতিও নয়। অথচ দেখুন, রহস্যের চাবিকাঠি যদি হাতে এসে যায় কয়লার দামে হীরে বিকোবার আগে, তাহলে কোটি কোটি মুদ্রার মালিক হয়ে বসা যাবে রাতারাতি।
একুশ বছর বয়সে হাতে ছিল হাজারখানেক পাউন্ড। ভেবেছিলাম, ছেলে পড়িয়ে আর এই মূলধন নিয়ে চালিয়ে যেতে পারব গবেষণা। দু-এক বছর দিব্যি চালিয়েও গেলাম– বেশির ভাগই বার্লিনে। তারপর শুরু হল গবেষণা গোপন রাখার ঝামেলা। আইডিয়াটা একবার ফাঁস হয়ে গেলেই তো লোকে হেঁকে ধরবে আমাকে। এমন একখানা আইডিয়া মাথায় আনার মতো বুদ্ধিমান চেহারাখানাও দেখানো উচিত নয় পাঁচজনের কাছে। নকল হীরে টন-টন বানাতে পারি, এ কথা একবার জানাজানি হয়ে গেলে গবেষণা শিকেয় উঠবে দুদিনেই। তাই কাজ চালাতে হল চুপিসারে-কাকপক্ষীকে না জানিয়ে। প্রথমদিকে নিজস্ব ছোট্ট ল্যাবরেটরি ছিল। হাতের পয়সা ফুরিয়ে আসার পর কেন্টিসটাউনে আমার জঘন্য নেড়া ঘরের মধ্যেই গবেষণা চালিয়ে গেলাম। যন্ত্রপাতির পাশে মেঝের ওপর লেপ-তোশক নিয়ে রাত কাটিয়েছি বছরের পর বছর। টাকা উড়তে লাগল খোলামকুচির মতো। খাওয়াদাওয়ার কষ্ট গায়ে মাখিনি–কিপটেমি করিনি কেবল যন্ত্রপাতি কেনার ব্যাপারে। ছেলে পড়িয়ে দুপয়সা রোজগার করাটাও দেখলাম এক ঝকমারি ব্যাপার। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ডিগ্রি আমার নেই। কেমিস্ট্রি ছাড়া আর কোনও শাস্ত্র জানা নেই। তার ওপর, ছেলে-পড়ানো আমার ধাতে সয় না। সবচেয়ে বড় অসুবিধে, সময় নষ্ট। বেশ খানিকটা দামি সময় খরচ হয়ে যেতে লাগল গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানাতে গিয়ে। এত কষ্টের মধ্যেও কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমার লক্ষ্যের দিকে তিল তিল করে। তিন বছর আগে মিশ্রণ-প্রবাহের উপাদান বার করলাম, কতখানি চাপ দেওয়া দরকার, তা-ও বার করলাম। তারপর সেই মিশ্রণ-প্রবাহের সঙ্গে হিসেবমতো কার্বন উপাদান মিশিয়ে মুখবন্ধ বন্দুকের চোঙার মধ্যে ঢুকিয়ে, জল ভরে টাইট করে এঁটে গরম করতে লাগলাম।