চ্যান্সারি লেনে কাজে আটকে গিয়ে দেরি হয়ে গিয়েছিল। রাত নটা নাগাদ মাথা টিপটিপ করতে লাগল। আমোদ-আহ্লাদ অথবা নতুন কাজ, কোনওটাই আর ভালো লাগছিল না। তাই এসে দাঁড়িয়েছিলাম নদীর পাড়ে–ব্রিজের ওপর। প্রশান্ত রাত। নদীর দুপাড়ে ঝলমল করছে অজস্র রঙের আলো। কালো ময়লা জলের ওপর হরেক রঙের প্রতিফলন। লাল, জ্বলন্ত কমলা, গ্যাস-হলুদ, বিদ্যুৎ-সাদা, বিবিধ ছায়ামিশ্রিত অবস্থায় রকমারি রং ফুটিয়ে তুলেছে দুপাড়ে। মাথার ওপর নক্ষত্রখচিত আকাশের বুকে ওয়েস্টমিনস্টারের ধূসর চূড়া। নদীর জল প্রায় নিঃশব্দে বয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ হচ্ছে মৃদু ছলছলাত শব্দে, ভেঙে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে জলের ওপরকার রঙের প্রতিবিম্ব।
পাশেই ধ্বনিত হল একটা কণ্ঠস্বর, চমৎকার রাত।
মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম বক্তাকে। আমার পাশেই রেলিং-এ ভর দিয়ে চেয়ে আছে মরণ কালো জলধারার দিকে। দেখা যাচ্ছে তার মুখের পার্শ্বরেখা। মার্জিত মুখ। অ-সুদর্শন নয়, কিন্তু মেচেতা-পড়া। বিলক্ষণ বিবর্ণ। কোটের কলার উঁচু-করা। পোশাক আর মুখ দেখলেই বোঝা যায় সমাজে তার স্থান খুব উঁচুতে নয়। নিশ্চয় ভিক্ষে চাইবে গায়ে পড়ে আলাপ করার পর।
তাকিয়ে ছিলাম কৌতূহলী চোখে। ভিক্ষুক দুশ্রেণির হয়। এক শ্রেণির হয় গল্পবাজ, কথার ধোকড়। বোলচাল শুনিয়ে হাত পাতে, এক পেট খাওয়ার পয়সা পেলেই খুশি। আর-এক শ্রেণির মুখে খই ফোটে না, নিজের মতো হাত পেতেই খালাস। এই লোকটার কপালে আর চোখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ লক্ষ করে আঁচ করতে পারলাম, ভিক্ষাবৃত্তি ঘটবে কোন পথে।
বললাম, খুবই চমৎকার, তবে আপনার আর আমার পক্ষে নয়, অন্তত এই জায়গায়।
নদীর দিকেই চোখ রেখে সে বলল, তা নয়। তবে এই মুহূর্তে বড় ভালো লাগছে।
একটু থামল। ফের বললে, লন্ডনের কাজকারবার, উদবেগ, দুশ্চিন্তা নিয়ে সারাদিন কাটানোর পর মাথাটাকে জিরেন দেওয়ার পক্ষে এমন খাসা জায়গা আর নেই। দুনিয়াটাই ধকল সওয়ার জায়গা, উদয়াস্ত মেহনত করতেই হবে, নইলে ঠাঁই নেই কোথাও। ধকল যখন ক্লান্তি আনে দেহে-মনে, তখনই মানুষ ছুটে আসে এমন নিবিড় শান্তির জায়গায়, যেমন আপনি এসেছেন। কিন্তু আমার মতো ক্লান্ত আপনি নন। আমার মতো মাথার ঘায়ে কুকুর-পাগল অবস্থা আপন হয়নি। আমার মতো হেঁটে হেঁটে পায়ের তলায় ফোঁসকা তুলে ফেলেননি। আমার মতো মস্তিষ্কের প্রতিটা কোষকে বেদম করে ফেলেননি। মাঝে মাঝে মনে হয় কেন এত খেটে মরছি? লাভ কী? একখানা মোমবাতির দামও উঠবে কি না সন্দেহ। ইচ্ছে হয় নাম, যশ, প্রতিপত্তি, সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মামুলি কারবার নিয়ে থাকি। কিন্তু পারি না। কেন জানেন? উচ্চাশা যদি ত্যাগ করি, শেষ জীবনটা অনুতাপে জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাব।
সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম লোকটার দিকে। এরকম দারিদ্র-বিশুষ্ক মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। শতচ্ছিন্ন পোশাক রীতিমতো ময়লা। দাড়িগোঁফ কামানোর পয়সা জোটেনি। চুলে চিরুনি পড়েনি। দিন সাতেক ডাস্টবিনে শুয়ে ছিল যেন। কিন্তু লম্বা লম্বা কথা কী! বিশাল কারবার চালিয়ে হেদিয়ে পড়েছে। ইচ্ছে হল, অট্টহেসে থামিয়ে দিই বোলচাল।
ব্যঙ্গের সরে তাই বলেছিলাম, উচ্চাশা আর সামাজিক প্রতিপত্তি মানুষকে খাটায় ঠিকই, কিন্তু ক্ষতিপূরণও করে দেয়। প্রভাব, সৎ কাজের আনন্দ, গরিবদের সাহায্য করার সুযোগ, মাতব্বরির সুবিধে
কথাগুলো বলবার সময়ে একটু যে অনুতাপ হয়নি তা নয়। দারিদ্রকে এভাবে কশাঘাত করা কুরুচির পরিচয়। কিছু লোকটার চেহারা আর চ্যাটাং চ্যাটাং কথার বৈষম্য তাতিয়ে তুলেছিল আমাকে।
সে কিন্তু শান্ত-সংযত মুখে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল আমার পানে।
তারপর বললে, ভুল করেছি আপনাকে বিশ্বাস করাতে গিয়ে। কেউ করেনি, আপনি তো করবেনই না। পুরো ব্যাপারটা এমনই উদ্ভট যে, গোড়া থেকে যদি শোনেন, হেসে খুন হবেন। কিন্তু ঠিক সেই কারণেই বলব আপনাকে নিজের নিরাপত্তার জন্যেই বলব। বিশ্বাস করলেই তো বিপদে ফেলবেন। সত্যিই বিরাট কারবার নিয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছি আমি– সে যে কত বড় ব্যাবসা, কল্পনাও করতে পারবেন না। এই কারবারই কিন্তু এখন ঝামেলায় ফেলেছে আমাকে। খুলেই বলি… আমি হীরে বানাই।
বেকার রয়েছেন মনে হচ্ছে?
সহিষ্ণুতার বাঁধ ভেঙে পড়ে আমার এই টিটকিরির জবাবে–দোহাই আপনার, আর খোঁচা মারবেন না। অবিশ্বাসের হাসি আর সহ্য করতে পারছি না। বলতে বলতে ঘচাঘচ করে খুলে ফেলল কোটের বোতাম। সুতো দিয়ে গলায় ঝোলানো একটা ক্যানভাসের থলি টেনে নামিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল তার মধ্যে। টেনে বার করল একটা বাদামি নুড়ি। আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললে চাপা গলায়, জানি না এ জিনিস চেনবার বিদ্যে আপনার আছে। কি না। দেখুন, দেখুন।
বছরখানেক আগে হাতে একটু সময় পেয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। লন্ডন সায়েন্স ডিগ্রি অর্জন করেছিলাম। পদার্থবিজ্ঞান আর খনিজবিজ্ঞান সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জ্ঞানগম্যি ছিল সেই কারণেই। বাদামি নুড়ির মতো বস্তুকে হাতের তেলোয় নিয়ে দেখেই খটকা লাগল এই বিদ্যেটুকু জানা ছিল বলেই। জিনিসটাকে গাঢ় বর্ণের আকাটা হীরের মতোই দেখতে। কিন্তু বেজায় বড় হীরে। আমার এই বুড়ো আঙুলের মতো বিরাট। উলটে-পালটে দেখলাম, রত্নের রাজা হীরের যেমন ছকোনা আকৃতি থাকে, নুড়িপাথরটার আকৃতিও হুবহু তা-ই। গোলাকার মুখগুলোও অবিকল হীরের মুখের মতো। পেনশিল-কাটা ছুরি ছিল পকেটে। বার করলাম। ধারালো ফলা দিয়ে কাটতে গেলাম–আঁচড় পড়ল না। গ্যাস ল্যাম্পের দিকে ঝুঁকে পড়ে নুড়িপাথর দিয়ে কবজি-ঘড়ির কাঁচে আঁচড় দিতেই কাচ কেটে গেল সহজেই। কৌতূহল মাথাচাড়া দিল মগজের মধ্যে তৎক্ষণাৎ।