আচম্বিতে স্তব্ধ হয়েছিল পদশব্দ। কান খাড়া করেছিল প্ল্যাটনার আবার সেই রক্ত উত্তাল করা অপার্থিব আওয়াজ শোনার প্রত্যাশায়। কিন্তু নিথর নীরবতা ছাড়া কানের পরদায় আর কিছুই ধরা পড়েনি। তারপরেই, সহসা যেন শানিত ছুরিকাঘাতে ফর্দাফাঁই হয়ে গিয়েছিল থমথমে নৈঃশব্দ্য–কানের ওপর আছড়ে পড়েছিল তীক্ষ্ণ ঘণ্টাধনি।
প্রথম শব্দটার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য মুখ দুলে উঠে ছুটে গিয়েছিল আশপাশ দিয়ে। আরও জোরালো হাহাকারের বুক-ভাঙা বিলাপে শিউরে উঠেছিল প্ল্যাটনার। স্ত্রীলোকটার কানে কিন্তু বুক চাপড়ানোর মতো এত জোর আওয়াজের বিন্দুবিসর্গ পৌঁছায়নি। তন্ময় হয়ে সে তখন মোমবাতির আলোয় পুড়িয়ে ছাই করছে একটা কাগজ। দ্বিতীয়বার ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আবছা হয়ে এসেছিল সবকিছুই, হিমশীতল একটা দমকা হাওয়া পাঁজর-ভাঙা দীর্ঘশ্বাসের মতোই বয়ে গিয়েছিল ভাসমান মুখগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে। বসন্তের হাওয়ায় মরা পাতা যেভাবে উড়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেইভাবেই অগুনতি মুখকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল কনকনে বাতাসের ঝাপটা, তৃতীয়বার ঘণ্টার আওয়াজ শ্বাসরোধী নৈঃশব্দ্যকে খানখান করে ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী যেন একটা এগিয়ে। গিয়েছিল শয্যা অবধি। অলোকরশ্মির কথা আপনারা অনেক শুনেছেন। কিন্তু সেদিন। প্ল্যাটনার যা দেখেছিল চোখ রগড়ে নিয়ে, তা অন্ধকারের রশ্মি, ছায়াময় একটা হাত আর তার বাহু!
দিগন্তব্যাপী ধু-ধু কালো শূন্যতাকে তখন গ্রাস করছে সবুজ সূর্য। ভোর হচ্ছে সবুজ দুনিয়ায়। আসছে ঘরের দৃশ্য। শয্যায় শায়িত হাড় বার-করা মানুষটা বিষম যন্ত্রণায় তেউড়ে ফেলেছিল সারা শরীর, বীভৎসভাবে বিকৃত হয়েছিল মুখ। চমকে ঘাড় ফিরিয়েছিল স্ত্রীলোকটা।
ঠান্ডা কনকনে হাওয়ার ঝাপটায় সন্ত্রস্ত মুখগুলো ভেসে উঠেছিল মাথার ওপর মেঘের মতো–সবুজ ধুলোর মতো উড়ে গিয়েছিল দমকা বাতাসে খাদের মধ্যেকার মন্দিরের দিকে হু হু করে। ঘাড়ের ওপর দিয়ে বিস্তৃত ছায়াময় কালো বাহুর অর্থ আচম্বিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল প্ল্যাটিনারের অবশ চেতনায়।
অন্ধকারের হাত তখন খামচে ধরেছে মুমূর্ষ শিকারকে। ঘাড় ফিরিয়ে বাহুর অধিকারী কৃষ্ণ ছায়াকে দেখার সাহস হয়নি প্ল্যাটনারের। প্রবল চেষ্টায় শক্তি জুগিয়েছিল অসাড় পা দুখানায়। দুহাতে মুখ ঢেকে দৌড়াতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল একটা গোল পাথরের ওপর–হাতের শিশি পাথরে লাগার সঙ্গে সঙ্গে চুরমার তো হয়েছিলই–প্রলয়ংকর বিস্ফোরণটা ঘটেছিল ঠিক তখনই।
পরের মুহূর্তেই দেখেছিল, রক্তাক্ত হাতে বিমূঢ় মস্তিষ্কে বসে রয়েছে লিডগেটের মুখোমুখি–স্কুলের পেছনে পাঁচিলে ঘেরা বাগানে।
প্ল্যাটনারের গল্পের শেষ এইখানেই। গল্প-লেখকের কায়দায় কিন্তু গল্পটা উপহার দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত। সে চেষ্টাও করিনি। কল্পনার সাজ পরিয়ে এ ধরনের আজগুবি কাহিনিকে বিশ্বাসযোগ্য করার ধারকাছ দিয়েও যাইনি। প্ল্যাটনার যেভাবে বলেছে, লিখলামও সেইভাবে। মৃত্যুদৃশ্যকে গল্পের প্লটে ফেলে প্ল্যাটনারকে তার মধ্যে জড়িয়ে দিতে পারলে মন্দ হত না ঠিকই। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে নির্জলা সত্য কাহিনিটা মিথ্যা হয়ে দাঁড়াত। সবুজ দুনিয়ার ছায়ামায়া এভাবে ফুটে উঠত না, ভাসমান মুখদের এভাবে হাজির করা যেত না, অন্ধকারের দুনিয়ার বিচিত্র প্রভাবকে এভাবে উপলব্ধি করা যেত না। খেয়াল রাখবেন, তাদের দেখা যাচ্ছে না ঠিকই–অষ্টপ্রহর কিন্তু বিশাল চোখ মেলে নজর রেখেছে আমাদের প্রত্যেকের ওপর।
শুধু একটা কথা বলা দরকার। স্কুল-বাগানের ঠিক পাশেই ভিনসেন্ট টেরেসে সত্যিই মারা গিয়েছিল এক ব্যক্তি–প্ল্যাটনারের পুনরাবির্ভাবের মুহূর্তে। মৃত ব্যক্তি পেশায় খাজনা আদায়কারী এবং বিমা এজেন্ট। বিধবা স্ত্রীর বয়স অনেক কম। গত মাসে বিয়ে করেছে অলবিডিং-এর পশুচিকিৎসক মি. হোয়াইম্পারকে। উপাখ্যানের এই অংশটা লোকমুখে জেনেছে এ তল্লাটের প্রত্যেকেই। এই কারণেই কাহিনিতে তার নাম উল্লেখ করার অনুমতিও দিয়েছে আমাকে। একটি শর্তে। মৃত স্বামীর অন্তিম মুহূর্তে প্ল্যাটনার যা যা দেখেছে, তার সবই যে ভুল, আমাকে তা লিখতে হবে। না, কোনও উইল সে পোড়ায়নি। একটাই উইল করেছিল লোকান্তরিত স্বামী বিয়ের ঠিক পরেই। প্ল্যাটনার কিন্তু উইল পোড়ানোর কোনও কথাই বলেনি অথচ ঘরের কোন ফার্নিচারটি কোথায় আছে, তা নিখুঁতভাবে বলে গেছে। বাস্তবে তা মিলেও গেছে। আরও একটা কথা। যদিও আগেও বলেছি কথাটা, আবার বলছি। বলতে বাধ্য হচ্ছি কুসংস্কারাচ্ছন্নদের ভয়ে। প্ল্যাটনার নদিন অন্তর্হিত হয়েছিল এই দুনিয়ার বাইরে–এ ঘটনার সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। তাতে কিন্তু তার কাহিনির সত্যতা প্রমাণিত হচ্ছে না। স্থান এর বাইরেও চোখের ভ্রান্তি অসম্ভব কিছু নয়। পাঠক-পাঠিকারা শুধু এইটুকুই মনে রাখবেন।
হীরে কারিগর
হীরে কারিগর ( The Diamond Maker )
[‘The Diamond Maker’ ১৮৯৪ সালের আগস্ট মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৮৯৫ সালে লন্ডনের ‘Methuen & Co.’ থেকে প্রকাশিত ওয়েলসের প্রথম ছোটগল্পের সংকলন ‘The Stolen Bacillus and Other Incidents’ তে গল্পটি স্থান পায়।]