প্ল্যাটনার নিজে থেকে ব্যাখ্যা হাজির করার কোনও চেষ্টাই করেনি–যা দেখেছে, সেই গল্পই কেবল শুনিয়েছে। সজীব মানুষদের চোখে চোখে রেখেছে যারা, তারা কে, সত্যিই তারা মৃত সত্তা কি না, লোকান্তরে যাওয়ার পরেও ইহলোকের মানুষদের নিয়ে কেন তাদের এত মাথাব্যথা–এসবই আমাদের অনুমান করে নিতে হবে। আমার যা মনে হয়, তা এই: এ জীবনে ভালো করি কি মন্দ করি, তার রেশ থেকে যায় জীবন সমাপ্ত হয়ে যাবার পরেও। লোকান্তরের পরেও তা দেখে যেতে হয় আমাদের প্রত্যেককেই–পার পায় না কেউই। মৃত্যুর পর আত্মা যদি থাকে, মৃত্যুর পর মানবিক আগ্রহও টিকে থাকে। বিনাশ নেই আত্মার, বিনাশ নেই আগ্রহেরও। প্ল্যাটনার কিন্তু জানায়নি ওর মনের কথা–যা বললাম, তা আমার নিজস্ব ধারণা। দিনের পর দিন সবুজ দুনিয়ার ক্ষীণ আলোকের মধ্যে ক্ষিপ্তের মতো সে ঘুরে বেড়িয়েছে, ক্লান্তিতে দেহ-মন ভেঙে পড়েছে, মাথায় চরকিপাক লেগেছে, শেষের দিকে খিদে-তেষ্টায় কাহিল হয়ে পড়েছে। দিনের বেলায়–মানে পার্থিব দিবসের আলোকে–পরিচিত সাসেক্সভিলের ভূতুড়ে ছায়ার মতো মানুষজন-দৃশ্য তাকে উদ্ভ্রান্ত করেছে। বুঝতে পারেনি কোথায় পা রাখা উচিত–প্রায়ান্ধকারে ঠাহর করতে পারেনি কিছুই। এরই মধ্যে কখনও সখনও সজাগচক্ষু আত্মার হিমশীতল পরশ বুলিয়ে গেছে মুখের ওপর। মানসিক অবস্থা অবর্ণনীয় হয়ে উঠেছে রাত নামলে। হেঁকে ধরেছে অসংখ্য পর্যবেক্ষক–পাহারাদারও বলা যায়। অগুনতি বিশাল চোখে মূর্ত নিঃসীম, বেদনা উন্মাদ করে ছেড়েছে তাকে। আতীব্র বাসনা হয়েছে ইহলোকে কিন্তু আসার–এত কাছে থেকেও কিন্তু অনেক দূরে থেকে গিয়েছে চেনাজানা এই জগৎ। অতৃপ্ত বাসনা ধিকিধিকি অনলের মতো পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছে তাকে। মানসিক গ্লানি, অব্যক্ত বিষাদ তুঙ্গে পৌঁছেছে আশপাশের অপার্থিব ব্যাপারস্যাপার ইচ্ছে না থাকলেও দেখতে হয়েছে বলে। যন্ত্রণা কুরে কুরে খেয়েছে নীরব পাহারাদারদের ছিনেজোঁকের মতো পেছনে লেগে থাকা দেখে, চেঁচিয়েছে, যা মুখে এসেছে তা-ই বলেছে, পালাতে গিয়েছে, পালাতে গিয়ে বন্ধুর পথে মুখ থুবড়ে পড়েছে–তবুও সবুজ দুনিয়ার নাছোড়বান্দা পাহারাদাররা তার সঙ্গ ছাড়েনি, তার ওপর থেকে নজর সরিয়ে নেয়নি, তাকে রেহাই দেয়নি। অগুনতি মূক চাহনি নজরবন্দি রেখেছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। প্ল্যাটনারের তখনকার আতীব্র যন্ত্রণা পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারবেন।
নবম দিবসে সন্ধ্যা নাগাদ আবার সেই অদৃশ্য পায়ের আওয়াজ শুনেছিল প্ল্যাটনার। তালে তালে পায়ের মালিকরা এবার এগিয়ে আসছে বহু দূর থেকে খাদের সীমাহীন পথের ওপর দিয়ে–ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ আওয়াজ ধ্বনি আর প্রতিধ্বনির রক্ত-জমানো শব্দতরঙ্গ তুলছে দিকে দিকে। নদিন আগে ইহলোক থেকে মরলোকের যে পাহাড়ে অবতীর্ণ হয়েছিল প্ল্যাটনার, সেই মুহূর্তে ছিল সেই পাহাড়েই, প্রায় সেই জায়গাটিতেই। আওয়াজ শুনেই ধড়ফড় করে নেমে আসছিল পাহাড় বেয়ে খাদের দিকে। রহস্যময় পায়ের মালিকদের স্বচক্ষে দেখবার এ সুযোগ কি ছাড়া যায়? কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল স্কুলের কাছেই একটা ঘরের মধ্যেকার দৃশ্য দেখে। দুজন মানুষ ছিল ঘরে। দুজনেই তার মুখ-চেনা, জানলা খোলা। খড়খড়ি তোলা। অস্তগামী সূর্যের আলো সটান ঢুকছে ঘরের মধ্যে খোলা জানলা দিয়ে। ঘরের সবকিছুই তাই প্রথমদিকে দেখা গিয়েছিল উজ্জ্বলভাবে। বেশ বড় লম্বাটে খোলামেলা ঘর। কালো নিসর্গদৃশ্য আর নীল-কৃষ্ণ সবুজাভ উষার পটভূমিকায় ম্যাজিক-লণ্ঠনের ছবির মতোই তা বিচিত্র। রোদ্দুরের আলো ছাড়াও সবে ঘরে জ্বালানো হয়েছে একটা মোমবাতি।
শয্যায় শুয়ে এক লিকলিকে কঙ্কালসার পুরুষ। লন্ডভন্ড বালিশে রাখা মাথা। বীভৎস সাদা মুখে অতি ভয়ংকর যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। দুহাত মুঠি পাকিয়ে তুলে রেখেছে মাথার দুপাশে। খাটের পাশে একটা ছোট্ট টেবিল। টেবিলের কাছে ওষুধের খানকয়েক শিশি, কিছু সেঁকা রুটি আর জল, আর খালি গেলাস। মুহুর্মুহু দ্বিধাবিভক্ত হচ্ছে তার দুঠোঁট, কী যেন বলতে চাইছে–পারছে না। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছে না। সেদিকে দৃষ্টি নেই ঘরের দ্বিতীয় ব্যক্তির। পেছন ফিরে উলটোদিকে সেকেলে আলমারি খুলে কাগজপত্র হাঁটকাচ্ছে একটি স্ত্রীলোক। প্রথমদিকে রীতিমতো উজ্জ্বল স্পষ্ট থাকলেও পেছনের সবুজ উষা ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে ওঠার ফলে সামনের এই ছবিও তাল মিলিয়ে ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে এল একটু একটু করে।
প্রতিধ্বনির রেশ তুলে দূরের পদশব্দ তখন এগিয়ে আসছে তো আসছেই। অন্য জগতে সেই নিয়মিত ছন্দের ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ আওয়াজ মাদল-বাজনার মতোই গুরুগম্ভীর, বুকের রক্ত ছলকে ছলকে ওঠে। এই জগতে আওয়াজ পৌঁছাচ্ছে কিন্তু শব্দহীন কম্পনের আকারে। প্ল্যাটনারের বর্ণনাই হুবহু তুলে দিলাম। ভয়-ধরানো রক্ত হিম-করা সেই পদশব্দ যতই নিকটে এসেছে, ততই কোত্থেকে যেন অগুনতি অস্পষ্ট মুখ জড়ো হয়েছে মুমূর্ষর ধারেকাছে, জানালায় জানলায়। অন্ধকারের ভেতর চেয়ে থেকেছে ঘরের দুই ব্যক্তির দিকে –একজন শব্দহীন কণ্ঠে মরার আগে কিছু চাইছে–আর একজন সেদিকে না তাকিয়ে কাগজ হাঁটকে চলেছে। নির্বাক বিস্ময়ে চেয়ে থেকেছে প্ল্যাটনার। এই কদিন সবুজ দুনিয়ায় কাটিয়েও একসঙ্গে এত পাহারাদার পর্যবেক্ষককে এক জায়গায় জড়ো হতে সে একবারও দেখেনি। একদল নির্নিমেষে দেখছে মুমূর্মুকে–আর-একদল নিঃসীম ও নিদারুণ মনস্তাপ নিয়ে চেয়ে থেকেছে স্ত্রীলোকটির দিকে। কাগজের পর কাগজ দেখছে সে–কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না ঈপ্সিত বস্তু। চোখে ঝরে পড়ছে সীমাহীন লোভ, কদর্য লালসা। প্ল্যাটনারকে ঘিরে ধরেছিল এরা, চোখের সামনে ভিড় করে দাঁড়ানোয় ঘরের দৃশ্য আর সুস্পষ্ট দেখা যায়নি। শুধু শোনা গেছে অবিরাম আক্ষেপের হাহাকার। মাঝেমধ্যে অবশ্য পলকের জন্যে দেখা গেছে ঘরের দৃশ্য। প্ল্যাটনার দেখেছে, বিশাল চক্ষু মেলে অগুনতি মুখের একটা দল ভিড় করেছে স্ত্রীলোকটির চারপাশে। সবুজ প্রতিফলন কেঁপে কেঁপে ওঠা সত্ত্বেও সে দেখেছে, নিস্তব্ধ নিথর ঘরের মধ্যে মোমবাতির সটান ধোঁয়া উঠছে ওপরে। কানে ভেসে এসেছে বজ্রনির্ঘোষের মতো ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ পায়ের আওয়াজ। দিগদিগন্ত কাঁপিয়ে তারা আসছে… তারা আসছে! যাদের দেখা যায় না… তারা আসছে। ততই নিবিড় হয়ে উঠেছে ঘরের মধ্যে কাতারে কাতারে ভিড়-করা ভাসমান মুখগুলোর চাহনি। মেয়েটির একদম কাছ ঘেঁষে ভেসে থাকা বিশেষ দুটি মুখের বর্ণনা বড় নিখুঁতভাবে দিয়েছিল প্ল্যাটনার। দুজনের একজন নারী। মুখভাব কঠোর ছিল নিশ্চয় এককালে। অপার্থিব জ্ঞানের পরশে এখন তা কোমল। অপরজন নিশ্চয় স্ত্রীলোকটির পিতৃদেব। দুজনেই পলকহীন চোখে স্ত্রীলোকটির জঘন্য নীচ কাণ্ডকারখানা দেখে যেন মরমে মরে রয়েছে–কিন্তু বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আর নেই বলে কিছু করতেও পারছে না। এদের পেছনে ভাসছে সম্ভবত কিছু কুলোকের মুখ– একদা যারা কুশিক্ষা দিয়ে অধঃপাতে নামিয়েছে স্ত্রীলোকটিকে রয়েছে সৎ বন্ধুরা ব্যর্থ হয়েছে যাদের সৎ প্রভাব। ভাসমান মুখদের আর-একটা দল কাতারে কাতারে জড়ো হয়েছে শয্যাশায়ী মুমূর্ষ ব্যক্তির ওপর। দেখে মনে হয় না বাবা-মা বা বন্ধুবান্ধবস্থানীয়। প্রতিটি মুখ নারকীয়ভাবে আচ্ছন্ন ছিল নিশ্চয় কোনও এককালে, কিন্তু রুক্ষতা কোমল হয়ে এসেছে অপরিসীম দুঃখতাপে! সবার সামনে রয়েছে একটা বাচ্চা মেয়ের মুখ। রাগ নেই, অনুশোচনা নেই। অসীম ধৈর্য নিয়ে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ে যেন প্রতীক্ষা করছে সব কষ্ট অবসানের। একসঙ্গে এত মুখ এক জায়গায় কখনও দেখেনি বলেই সব মুখের বর্ণনা দিতে আর পারেনি প্ল্যাটনার। ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে তমিস্রা ফুড়ে আবির্ভূত হয়েছিল এদের প্রত্যেকে নিঃশব্দে… চোখের পলক ফেলতে যেটুকু সময় লাগে, তার মধ্যেই এত দৃশ্য দেখে নিয়েছিল প্ল্যাটনার। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল নিশ্চয় লোমকূপের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, অণু-পরমাণুতে, শিরায়, ধমনিতে। তাই অজান্তেই কখন জানি পকেটে হাত ঢুকিয়ে সবুজ গুঁড়োর শিশিটা টেনে এনে বাড়িয়ে ধরেছিল সামনে। একেবারেই অজান্তে–কখন যে পকেটে হাত ঢুকিয়ে শিশি টেনে বার করেছিল–প্ল্যাটনারের তা একেবারেই মনে নেই।