খাদের ঢাল বেয়ে নির্মিত সমাধিসৌধগুলির পাশ দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে নিচে নামবার সময়ে মস্তিষ্ককে কিন্তু বিরাম দেয়নি। অব্যাখ্যাত এই রহস্যের সমাধানসূত্র অন্বেষণের চেষ্টা চালিয়ে গেছে বিরামবিহীনভাবে। অনেকক্ষণ পরে পৌঁছেছিল মস্ত জমকালো সমাধিস্তম্ভের মতো দেখতে সেই অট্টালিকার সামনে। এই সৌধের ভেতর থেকেই পিলপিল করে গোল মুন্ডুদের ভেসে বেরিয়ে আসতে দেখেছিল একটু আগে। থমকে দাঁড়িয়েছিল প্রবেশ পথের সামনে। দেখেছিল, ভেতরে একটা আগ্নেয় শিলা জাতীয় প্রস্তরবেদির ওপর জ্বলছে বেশ কিছু সবুজ আলো। মাথার ওপরে অনেক উঁচুতে ঘণ্টা-গম্বুজ থেকে বেদির ওপর নেমে এসেছে একটা ঘণ্টার দড়ি, চারপাশের দেওয়ালে আগুন অক্ষরে লেখা রয়েছে অনেক দুর্বোধ্য বিষয়–অজানা হরফগুলো কিন্তু চিনতে পারেনি। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে যখন আকাশ-পাতাল ভাবছে, তখন কানে ভেসে এসেছিল ভারী পায়ের আওয়াজ, প্রতিধ্বনি কাঁপতে কাঁপতে ভেসে আসছে রাস্তা থেকে। পায়ের মালিকরা যেন সরে যাচ্ছে দূর হতে দূরে-ধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল প্ল্যাটনার। দাঁড়িয়েছিল অন্ধকারে, কিন্তু কিছুই দেখেনি। প্রবল ইচ্ছে হয়েছিল ঘণ্টার দড়ি ধরে নৈঃশব্দ্য ভেঙে দেয় এই মৃত্যুপুরীর।
তারপর বাসনাটা মন থেকে তাড়িয়ে দৌড়েছিল বিলীয়মান পায়ের আওয়াজের পেছনে। দৌড়েছিল আর গলার শির তুলে চেঁচিয়ে গিয়েছিল। অনেক দূরে গিয়েও কিন্তু দেখতে পায়নি পায়ের মালিকদের–হাঁকডাক শুনে কেউ কৌতূহল চরিতার্থ করতেও এসে দাঁড়ায়নি ওর সামনে। খাদের যেন শেষ নেই–অসীম অনন্ত। পৃথিবীর নক্ষত্রালোকে যে আঁধার, সেই আঁধারে ঢাকা পুরো খাদ। ওপরে পাহাড়চুড়োয় কেবল দিনের আভাস–রক্ত হিম-করা সবুজ দিবস। খাদের নিচে ভাসমান মুন্ডুদের আর দেখা যাচ্ছে না। পাহাড়ের ওপরে অন্তর্হিত হয়েছে প্রত্যেকেই। মাথা তুলে তাদের দেখতেও পেয়েছিল প্ল্যাটনার। কেউ ভাসছে স্থির হয়ে শূন্যে, কেউ বাতাস কেটে ধেয়ে যাচ্ছে কামানের গোলার মতো বিপুল বেগে, কেউ কেউ মৃদু গতিতে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে পাহাড়চূড়ার আনাচকানাচে, ঠিক যেন তুষারপাত ঘটেছে মস্ত আকাশে–তবে তুষারের মতো ধবধবে সাদা নয় কেউই। কেউ কালো, কেউ ম্যাড়মেড়ে সবুজ।
পদশব্দ অনুসরণ করেও কিন্তু কারও নাগাল ধরতে পারেনি সে। ভারী ভারী পা ফেলে ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ শব্দে খাদ কাঁপিয়ে যারা হেঁটে গেছে, তারা কিন্তু একটুও তাড়াহুড়ো করেনি–তাল কেটে যায়নি। একই ছন্দে গুরুভার পদশব্দ ধ্বনি আর প্রতিধ্বনির রেশ জাগিয়ে তুলেছে অসীমের পানে বিস্তৃত অন্ধকারময় খাদের মধ্যে–তা সত্ত্বেও দৌড়ে বেদম হয়ে গিয়েও কারও টিকি ধরতে পারেনি প্ল্যাটনার–দেখতেও পায়নি। শয়তান-খাদের নানা অঞ্চলে ছুটে গিয়েছে, পাহাড় বেয়ে উঠেছে, নেমেছে, শিখরে শিখরে ঘুরে বেড়িয়েছে পাগলের মতো, ভাসমান মুলুদের পর্যবেক্ষণ করেছে নানানভাবে। এইভাবেই কেটেছে সাত-আটটা দিন। সঠিক হিসেব মনে নেই–হিসেব রাখার চেষ্টাও করেনি। দু-একবার মনে হয়েছে, সন্ধানী চোখের নজর রয়েছে তার ওপর–কিন্তু জীবন্ত কোনও সত্তার সঙ্গে বাক্যালাপের সুযোগ ঘটেনি। ঘুমিয়েছে পাহাড়ের ঢালু গায়ে, খাদের মধ্যে পার্থিব সব কিছুই অদৃশ্যই থেকে গিয়েছে–কারণ পার্থিব বিচারে সেখানকার সমস্তই তো গভীর পাতালে। উঁচু অঞ্চলে পার্থিব দিবস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান হয়েছে জগৎ। কখনও হোঁচট খেয়েছে গাঢ় সবুজ পাথরে, কখনও খাদের মধ্যে পড়তে পড়তে সামলে নিয়েছে কিনারা ধরে। সাসেক্সভিলের গলির পর গলি জেগে থেকেছে চোখের সামনে সর্বক্ষণ, যেন পাতলা ছায়ার মতো থিরথির করে দুলেছে, কেঁপেছে, ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে। কখনও মনে হয়েছে যেন হেঁটে চলেছে সাসেক্সভিলের রাস্তা বেয়ে, দুপাশের সারি সারি বাড়ির মধ্যে উঁকি মেরে দেখেছে গেরস্তদের ঘরকন্না–যা একান্তই গোপনীয়, তা-ও তার অজানা থাকেনি, তাকে কিন্তু কেউ দেখতে পায়নি, তার অস্তিত্বও টের পায়নি। তারপরেই আবিষ্কৃত হয়েছে চমকপ্রদ তথ্যটি। এই দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে সেই দুনিয়ার এক-একটি মুন্ডু। ভাসমান মুন্ডু। প্রত্যঙ্গহীন অসহায় সত্তারা খর-নজরে রেখেছে এই দুনিয়ার প্রতিটি ব্যক্তির ওপর।
প্ল্যাটনার কিন্তু কোনওদিনই জানতে পারেনি এরা কারা–সজীব মানুষদের যারা চোখে চোখে রেখেছে সবুজ দুনিয়া থেকে–আজও তাদের পরিচয় অজ্ঞাত রহস্যই থেকে গেছে। তার কাছে। এদের দুজন অবশ্য দু-একদিনের মধ্যেই দেখেছিল তাকে, ছায়ার মতো লেগে থাকত পেছনে। প্ল্যাটনারের মা আর বাবা মারা গেছে শৈশবে। স্মৃতির মণিকোঠায় মুখের ছবি এখনও রয়ে গেছে। ছেলেবেলায় সেই স্মৃতিচিত্রের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে যায় এই দুজনের মুন্ডুচিত্র। এ ছাড়াও মাঝে মাঝে অন্য মুখরাও বিশাল চোখের চাহনি নিবদ্ধ করেছে তার ওপর। একদা যারা ছিল তার আশপাশে, কেউ আঘাত দিয়েছে, কেউ সাহায্য করেছে, যৌবনে সঙ্গ দিয়েছে, আরও বড় হলে কাছে কাছে থেকেছে–কিন্তু এখন কেউ বেঁচে নেই–তাদের চোখের চাহনির সঙ্গে সবুজ দুনিয়ার এই এদের চাহনির মিল রীতিমতো বিস্ময়কর। চোখাচোখি হলেই অদ্ভুত দায়িত্ববোধে অভিভূত হয়েছে প্ল্যাটনার। মায়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু উত্তর পায়নি। বিষণ্ণভাবে স্থিরচোখে কেবল চেয়ে থেকেছে ছেলের দিকে–স্নেহকোমল চাহনির মধ্যে মিশে ছিল যেন মৃদু তিরস্কার।