অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে চলে আসছি। সবুজ সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যাটনারের চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল একটা টানা লম্বা রাস্তার দুধারে কালো বাড়ির সারি। স্পষ্ট নিকেতনের পর নিকেতন। খাদের মধ্যে। দ্বিধায় পড়েছিল প্ল্যাটনার–টহল দিয়ে আসাটা কি উচিত হবে? তারপর পা বাড়িয়েছিল দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে। খাড়াই পথ বেয়ে নেমে এসেছিল পাহাড়ের গা দিয়ে। কালঘাম ছুটে গিয়েছিল নামবার সময়ে। পাহাড়ি পথ এমনিতেই বন্ধুর, তার ওপর ছড়ানো রয়েছে আলগা নুড়ি। তেমনি খাড়াই। ঘণ্টাধ্বনি তখন থেমেছে। নিস্তব্ধ সেই অন্য দুনিয়ায় ওর পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। পায়ের ঠোক্করে ঠিকরে যাচ্ছে। শিথিল প্রস্তরখণ্ড। আগুন ঠিকরে যাচ্ছে পায়ের তলায়। কাছে আসতেই খটকা লেগেছিল প্ল্যাটনারের। এ কী আশ্চর্য সাদৃশ্য! রাস্তার দুধারে প্রতিটা বাড়িই কবর-প্রস্তর, স্মৃতিসৌধ, সমাধিমন্দিরের মতো দেখতে–তবে সাদা নয়–কালো। একই রকমের কালো আঁধার জমাট করে যেন নির্মিত গোরস্থানের মৃত্যুপুরী। তারপরেই চোখে পড়েছিল, সবচেয়ে বড় বাড়িটা থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে ম্যাড়মেড়ে, ফিকে সবুজ, গোলাকার বহু মূর্তি –ঠিক যেন গির্জার মধ্যে থেকে বেরচ্ছে ভক্তরা। ছড়িয়ে পড়ছে প্রশস্ত পথের দুপাশের অলিগলিতে। কাউকে দেখা যাচ্ছে গলি থেকে বেরিয়ে খাড়াই পাহাড় বেয়ে উঠতে, কেউ কেউ ঢুকছে পথের দুপাশে ছোট ছোট মসিবর্ণ বাড়িগুলোয়। প্ল্যাটনারের দিকেই অদ্ভুত গোলাকার সবুজ বস্তুগুলো ভাসতে ভাসতে উঠে আসছিল। দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে ছিল সে। পালে পালে যারা আসছে, তাদের কেউই কিন্তু হেঁটে আসছে না–হাত-পা-জাতীয় কোনও প্রত্যঙ্গই নেই তাদের; আকারে তারা মানুষের মাথার মতো–তলায় ঝুলছে ব্যাঙাচির মতো সরু একটা দেহ৷ ঝুলছে আর দুলে দুলে উঠছে। না, ভয় পায়নি প্ল্যাটনার। বিষম অবাক হয়ে গিয়েছিল বলেই মনে ভয় ঠাঁই পায়নি। এরকম সৃষ্টিছাড়া জীব সে জীবনে দেখেনি–কল্পনাতেও আনা যায় না। পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরের দিকে বয়ে আসা কনকনে হিমেল হাওয়ায় গা ভাসিয়ে তারা উঠে আসছিল নিঃশব্দে–ঠিক যেন দমকা হাওয়ায় ভেসে আসছে রাশি রাশি সাবানের বুদবুদ। সবচেয়ে কাছের প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে চক্ষুস্থির হয়ে গিয়েছিল প্ল্যাটনারের। সত্যি তা একটা মানুষের মুন্ডু! চোখ দুটো কেবল আশ্চর্য রকমের বিশাল। আত্যন্তিক বিষাদ আর নিদারুণ মনস্তাপ ভাসছে দুই চোখে-মরজগতের কোনও প্রাণীর চোখে এহেন ক্লিষ্ট ভাব দেখেনি প্ল্যাটনার। অবাক হয়েছিল ভাসমান মুভুদের চাহনি অন্যদিকে রয়েছে লক্ষ করে। প্ল্যাটনারকে দেখছে না কেউই নির্নিমেষে চেয়ে রয়েছে এমন কিছুর দিকে, যা দেখা যাচ্ছে না। প্রথমটায় ধাঁধায় পড়েছিল সে। তারপরেই মনে হয়েছিল, অসম্ভব এই প্রাণীরা বিশাল চোখ মেলে ছেড়ে আসা এই দুনিয়ার কোনও কিছুর দিকে চেয়ে আছে নিষ্পলকে–খুবই কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা; যা ওদের চোখে স্পষ্ট, প্ল্যাটনারের চোখে নয়। আরও কাছে এগিয়ে এসেছিল ভাসমান বর্তুলাকার ব্যাঙাচি দেহওয়ালা আজব প্রাণীরা–বিষম বিস্ময়ে চেঁচাতেও ভুলে গিয়েছিল প্ল্যাটনার। কাছাকাছি আসতে একটা বিরক্তি প্রকাশের খিটখিটে মেজাজের শব্দও কানে ভেসে এসেছিল–খুবই অস্পষ্ট–যেন চাপা অসন্তোষ ক্ষীণ কম্পন সৃষ্টি করে চলেছে অন্য দুনিয়ার বায়ুমণ্ডলে। আরও কাছে এসেই আলতোভাবে প্ল্যাটনারের মুখে ঝাপটা মেরে পাশ কাটিয়ে ভেসে গিয়েছিল পাহাড়চূড়ার দিকে! ঝাপটাটা মৃদু, কিন্তু বরফের মতো কনকনে।
একটা মুন্ডুই মুখ চাপড়ে দিয়ে গিয়েছিল প্ল্যাটনারের। কেন জানি ওর মনে হয়েছিল, বিশেষ এই মুন্ডুটার সঙ্গে লিডগেটের মুন্ডুর সাদৃশ্য আছে দারুণভাবে। অন্য মুন্ডুরা ঝাঁকে ঝাঁকে তখন উঠে যাচ্ছে ওপরদিকে। প্ল্যাটনারকে চিনতে পেরেছে, এমন ভাব প্রকাশ পায়নি কারওই চোখে। দু-একটা মুন্ডু ওর খুব কাছাকাছি এসেছিল, প্রথম মুন্ডুর মতো ঝাপটা মারতেও গিয়েছিল–প্রতিবারেই তিড়বিড়িয়ে উঠে শরীর কুঁচকে নিয়ে তফাতে সরে গিয়েছিল প্ল্যাটনার। প্রত্যেকের চোখেই কিন্তু একই সীমাহীন পরিতাপের অভিব্যক্তি দেখেছিল প্ল্যাটনার। একই রকমের নিঃসীম বিরক্তির ক্ষীণ গজগজানি ভেসে এসেছিল কানে। দু-একজনকে কাঁদতেও দেখেছিল। একজনকে দেখেছিল পৈশাচিক ক্রোধে প্রচণ্ড বেগে সাঁত করে পাশ কাটিয়ে ওপরে ধেয়ে যেতে। বাদবাকি সকলেই নিরুত্তাপ, নির্বিকার। কয়েকজনের চোখে অবশ্য দেখা গিয়েছিল পরিতৃপ্ত আগ্রহ। বিশেষ করে একজনের চোখে সুখ যেন ফেটে পড়ছিল! এর বেশি আর কিছু দেখেছে বলে মনে নেই প্ল্যাটনারের।
বেশ কয়েক ঘণ্টা এই দৃশ্য দেখেছিল সে। দলে দলে ভাসমান বর্তুলাকার প্রাণী বেরিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়চূড়ায়। তারপর যখন কাউকে আর বেরতে দেখা যায়নি কালো ছোট বাড়িগুলোর মধ্যে থেকে, তখন সাহসে বুক বেঁধে পা বাড়িয়েছিল নিচের দিকে। চারপাশের নিবিড় অন্ধকার তখন এমনই গাঢ় যে, পা ফেলতে হয়েছে আন্দাজে অন্ধের মতো। উজ্জ্বল ফ্যাকাশে সবুজ হয়ে উঠেছিল মাথার ওপরকার আকাশ। খিদে-তেষ্টার কোনও অনুভূতিই ছিল না। খাদের মাঝবরাবর পৌঁছে দেখেছিল একটা হিমেল জলস্রোত নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। বড় বড় গোলাকার পাথরে বিরল শৈবাল। মরিয়া হয়ে তা-ই মুখে পুরেছিল প্ল্যাটনার। মন্দ লাগেনি।