- বইয়ের নামঃ কল্পগল্প সমগ্র
- লেখকের নামঃ এইচ জি ওয়েলস
- প্রকাশনাঃ ফ্যান্টাস্টিক ও কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
কল্পগল্প সমগ্র
অঘটনবাজ
অঘটনবাজ ( The Man Who Could Work Miracles )
[‘The Man Who Could Work Miracles’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Illustrated London News’ পত্রিকায় জুলাই ১৮৯৮ সালে। ‘Doubleday & McClure Co.’ থেকে ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত ‘Tales of Space and Time’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। ১৯৩৭ সালে গল্পটি পরবর্ধিত আকারে ‘Roland Young’ অভিনীত ছায়াছবি হিসাবে মুক্তি পায়।]
ঈশ্বরদত্ত আশ্চর্য এই ক্ষমতা তার সহজাত কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে বিলক্ষণ। আমার তো মনে হয়, ক্ষমতাটা তার মধ্যে এসেছিল অকস্মাৎ। পয়লা নম্বরের নাস্তিক ছিল তিরিশে পা দেওয়ার আগে পর্যন্ত। অলৌকিক শক্তি যে আদৌ কারও থাকতে পারে, এ বিষয়ে বিশ্বাসী ছিল না মোটেই। আকারে নেহাতই খর্বকায়, চোখ দুটো গনগনে বাদামি, বেজায় খাড়া লাল চুল, গোঁফজোড়া রীতিমতো পাকানো এবং দুই প্রান্তে যখন-তখন পাক দেওয়াটা তার অষ্টপ্রহরের মুদ্রাদোষ। নাম তার জর্জ ম্যাকহুইরটার ফোদারিনগে। এ নাম যার থাকে, তাকে আর যা-ই হোক, কোনও অলৌকিক ব্যাপারস্যাপারের সঙ্গে জড়িত করা চলে না। পেশায় তো কেরানি। গলাবাজ তার্কিক। অলৌকিক কাণ্ডকারখানা ঘটা যে একেবারেই অসম্ভব, এই বিষয়টা বিষম গলাবাজি করে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই প্রথম মোলাকাত ঘটে গেল অলৌকিক ব্যাপারের সঙ্গেই। তর্ক চলছিল লং ড্রাগন পানশালায়। প্রতিপক্ষ টোডি বিমিসের তা যা বলেছ শব্দগুচ্ছের একঘেয়ে কশাঘাতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল মি. ফোদারিনুগের।
এই দুজন ছাড়াও পানশালায় সেদিন হাজির ছিল জনৈক ধূলিধূসরিত সাইকেল আরোহী, বাড়িওয়ালা কক্স এবং লং ড্রাগন-এর সুরা পরিবেশন করে যে মেয়েটি–মিস মেব্রিজ। তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে গেলাস ধুয়ে যাচ্ছিল আপন মনে। অন্য দুই ব্যক্তি সকৌতুকে শুনছিল ফোদারিনগের নিষ্ফল গলাবাজি। মি. বিমিসেয় নিরুত্তাপ মন্তব্য এবং নিরুত্তেজ তর্ককৌশলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে অলৌকিক ব্যাপারটাকে প্রাঞ্জল করতে প্রয়াস পেয়েছিল মি. ফোদারিনগে। বলেছিল, জিনিসটা আগে ভালো করে বোঝ। মির্যাল হল এমনই সব উদ্ভট আজগুবি ব্যাপারস্যাপার, যা নিত্যনৈমিত্তিক প্রাকৃতিক ব্যাপারস্যাপারের ঠিক উলটো ইচ্ছাশক্তির জোরে যে অঘটন ঘটানো চলে–বিশেষ ইচ্ছাশক্তি না থাকলে যা ঘটানো যায় না।
তা যা বলেছ, মি. বিমিস কুপোকাত করে দিয়েছিল তাকে আবার সেই মারাত্মক শব্দগুচ্ছ প্রয়োগে।
সমর্থনের আশায় কাতর চোখে সাইকেল-আরোহীর পানে চেয়েছিল মি. ফোদারিনগে। সে ভদ্রলোক এতক্ষণ শুনেই যাচ্ছিল নীরবে। এবার সমর্থন জ্ঞাপন করল খুকখুক করে একটু কেশে এবং মি. বিমিসের পানে এক ঝলক তাকিয়ে। এসব ঝক্কিঝামেলায় নাক গলাতে মোটেই চায় না বলে, উদাসীন রয়ে গেল বাড়িওয়ালা। মি. বিমিস কিন্তু মাথা নেড়ে মির্যাকল সংজ্ঞা মেনে নিতেই যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেল মি. ফোদারিনগে।
বললে বিষম উৎসাহে, যেমন ধর মির্যা ঘটানো যায় এইখানেই। ওই যে লম্ফটা দেখছ, ও লম্ফ কি শিখা নিচের দিকে করে কখনও জ্বলতে পারে? হ্যাঁ কি না, বলেই ফেলনা বিমিস।
তুমি তো বলেই দিলে–না, পারে না, উদাসীন জবাব বিমিসের।
আরে গেল যা! তোমার কী মনে হয়, সেটা তো বলবে।
না, পারে না।
তাহলে সমস্ত ইচ্ছাশক্তি জড়ো করে আমিই হুকুম দিচ্ছি সোজা লম্ফকে উলটো হয়ে জ্বলতে।ওহে লম্ফ! উলটে যাও! শিখা নিচের দিকে থাকুক–আছড়ে পড়ে ভেঙে যেয়ো না যেন!–এ কী!
এই যে এ কী! বিস্ময়োক্তি, এটা প্রত্যেকের গলা ফুড়ে তেড়েমেড়ে বেরিয়ে এসেছিল সেই মুহূর্তে। কেননা নিরেট বস্তুর জ্বলন্ত লম্ফ সহসা উলটে গিয়েছিল শূন্যে এবং মেঝের ওপর শূন্যে ভাসমান অবস্থায় থেকে জ্বলন্ত ছিল নির্বিকারভাবে। প্রজ্বলন্ত শিখা সটান বিস্তৃত নিচের মেঝের দিকে! যেন অতিশয় স্বাভাবিক ব্যাপার!
মি. ফোদারিনগে তখন কী করছে?
তর্জনী সামনে বাড়িয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছে কপালে। প্রবল চেষ্টায় যেন জড়ো করে রাখতে হচ্ছে ইচ্ছাশক্তিকে তিলমাত্র বিচ্যুতি ঘটলেই আছড়ে পড়ে তুবড়ে যাবে গদ্যময় লং ড্রাগন দীপাধার। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেও শেষরক্ষা করতে পারবে না।
ফোদারিনগের ঠিক পাশে ছিল সাইকেল-আরোহী। বিপুল লম্ফ মেরে ছিটকে সরে গেল ঘরের অপর প্রান্তে। তিড়িংবিড়িং করে অল্পবিস্তর লম্ফ দিল প্রত্যেকেই। মিস মেব্রিজ ঘাড় ফিরিয়ে অলৌকিক দৃশ্যটা প্রত্যক্ষ করেই এমন আঁ-আঁ-আঁ করে চেঁচিয়ে উঠল যে, গোবরাট থেকে একটা বেড়াল ধড়াস করে পড়ে গেল মেঝেতে। লম্ফ দেওয়া দূরের কথা, এক চুলও নড়বার সাহস হল না শুধু ফোদারিনগের। নড়লেই যদি আছড়ে পড়ে অসম্ভব লম্ফ!
ঝাড়া তিনটে সেকেন্ড কাটল এইভাবে–থমথমে স্তব্ধতার মধ্যে শূন্যে ঝুলে রইল লম্ফশিখা নিচের দিকে করে। ফোদারিনগে আর ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। ইচ্ছাশক্তি একাগ্র করে রাখা কি চাট্টিখানি কথা! কাতরোক্তি বেরিয়ে এল কণ্ঠ চিরে।