যে বিষয়টি আমি এখানে গুরুত্ব দিতে চাইছি তা হল, প্রতিটি গৃহস্থালিতে টয়লেটের ব্যবহার শুরু করানোটাই সব নয়। যা সব থেকে প্রয়োজনীয় তা হল, সঠিকভাবে বর্জ্য নিষ্কাশন এবং সেই বর্জ্যের সঠিক শোধন, যাতে পারিপার্শ্বিক থাকে নির্মল পরিচ্ছন্ন। একটি আদর্শ টয়লেট সাতটি চাহিদা পূরণ করে। আমাকে বলা হয়েছে দুই-পিটের টয়লেট এই সাতটি চাহিদা পূরণে আদর্শ। এই ব্যবস্থায় একটি পিট পরিপূর্ণ হয়ে গেলে, তা আর আগামী তিন বছর ব্যবহার করা হয় না। অন্য পিটটি তখন ব্যবহার করা হয়। এই তিন বছর প্রথম পিটের বর্জ্য জীবাণুমক্ত, পূতিগন্ধমুক্ত কঠিন সারে রূপান্তরিত হয়। কৃষিক্ষেত্রে ওই সার ব্যবহার হয়।
এই বর্জ্য বাদে গ্রামে অন্য বর্জ্য আসে পশুপাখি, গাছপালা, রান্নাবান্না, কাপড়চোপড় কাচা, থালাবাটি ধোয়া এমন নানান দৈনন্দিন কাজ থেকে। এগুলি দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: বায়োডিগ্রেডেবল বা জৈবিকভাবে পচ্য আর নন-বায়োডিগ্রেডেবল বা জৈবিকভাবে অপচ্য। গৃহস্থালির কাজে সাধারণ জ্বালানির পরিবর্তে জৈবিকভাবে পচ্য আবর্জনা থেকে তৈরি গুল ব্যবহার করা যায়। কোনও গ্রামে মানুষ ও পশুর সংখ্যা যদি অত্যধিক হয়, তাহলে জৈবিকভাবে পচ্য আবর্জনা থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে।
স্যানিটেশন ও টয়লেট পরিকাঠামো মিশন
স্যানিটেশন প্রকল্পকে পুরোপুরি সফল করতে আমার তরফে এই পরামর্শগুলি রইল:
১। ভারতের গ্রাম ও শহরাঞ্চলে টয়লেট ব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তিগত কারও ঘরে টয়লেট নির্মাণের থেকে জরুরি টয়লেট ব্যবস্থাকে সার্বিক পরিকাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা।
২। স্যানিটেশন ও টয়লেট ব্যবস্থার পরিকাঠামোর এই কর্মযজ্ঞে অনেকগুলি কাজ করতে হবে। প্রথমে একটি কেন্দ্রীয় ট্যাঙ্ক নির্মাণ করতে হবে। তারপর বর্জ্যকে সারে রূপান্তরিত করতে ও জলকে পুনর্ব্যবহারের জন্য একটি শোধন ব্যবস্থা করার সঙ্গে রাস্তা পর্যন্ত পাইপলাইনকে সম্প্রসারণ করে প্রতি ঘরের ও কমিউনিটি টয়লেট নির্মাণ করে মূল পাইপের সঙ্গে সংযোগ করে দিতে হবে। বর্জ্য জলের সব ক’টি নিকাশি পাইপ একটি আধারের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে। সেই আধারে জলকে পুনর্নবীকরণ ও শোধন করার ব্যবস্থা থাকবে। এই মডেলটি নতুন যে পিইউআরএ বা ‘পুরা’ (প্রোভাইডিং আরবান ফেসিলিটিজ় টু রুরাল এরিয়াজ়) প্রকল্প, বা শহরের বস্তি এবং সাধারণের উপযোগ ব্যবস্থায় প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৩। যে টয়লেটগুলি নির্মিত হবে তা বিশ্বাসযোগ্য, দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প জল ব্যবহারের উপযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ব্যক্তিগত টয়লেটগুলিতে পুনর্ব্যবহার্য জলের ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪। গ্রাম অঞ্চলে বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক টয়লেট ব্যবস্থায় ডেসিকেটিং ও কম্পোস্টিং মডেল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তার আগে বর্জ্যকে সম্পূর্ণ গন্ধমুক্ত করতে ও কম্পোস্টিং-এর ফলে উদ্গত সারকে যান্ত্রিক উপায়ে সরিয়ে ফেলার জন্য প্রয়োজন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে এগোনো।
৫। গ্রামোন্নয়ন, নগরোন্নয়ন, স্বাস্থ্য, সমাজ কল্যাণ, কর্মসংস্থান, জলসম্পদের মতো মন্ত্রকগুলি নিজেদের মধ্যে একটি কার্যকরী সম্পর্ক তৈরি করে নিতে হবে।
৬। নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদেরকে তাঁদের গ্রামের জন্য টয়লেট নির্মাণের আদর্শ মডেলটি বিবেচনা করে, তার নির্মাণের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য নিজেদের প্রশিক্ষিত করে নিতে হবে। সঠিক প্রযুক্তি তাঁদেরই বেছে নিতে হবে। পরিচর্যার জন্য সকল রকম ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তাঁদের গ্রামের টয়লেট ব্যবস্থা বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে, ত্রুটিমুক্তভাবে ও নির্বিঘ্নে চলতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রতিটি টয়লেট— ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত— কেন্দ্রীয় পরিকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত থাকে।
উপসংহার
২০২০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষ একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। সেই রূপান্তরের ভিত হচ্ছে স্যানিটেশন এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। এই ব্যবস্থা সরাসরি প্রভাব ফেলবে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর। জন্ডিস এবং অন্যান্য জলবাহিত রোগ ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ হ্রাস পাবে। একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা রাখতে হবে যা খেয়াল করবে, স্যানিটশন প্রকল্পগুলির প্রয়োগের সঙ্গে স্বাস্থ্য পরিসেবার খরচ কমছে কিনা। সুতরাং এই স্যানিটেশন প্রকল্পকে একটি লাভজনক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করতে তাই প্রয়োজন স্যানিটেশন ও টয়লেট পরিকাঠামো নির্মাণের এই উদ্যোগ।
.
তিন : ভ্রমণ থেকে উপলব্ধ কিছু শিক্ষা
ছ’দশকের আমার পেশাদারি জীবনে আমি বহু সংগঠনে, বহু পদে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, এবং আমাদের দেশের দৈর্ঘ্য প্রস্থ চষে বেড়িয়েছি। ২০০২ থেকে ২০০৭, আমি যখন রাষ্ট্রপতি পদে আসীন, আমি নিশ্চিত করেছিলাম যাতে আমি প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে ভাব আদানপ্রদান করতে পারি। সেই সুযোগে তাঁদের কাছ থেকে কিছু শিখতেও পারি। ভারতবর্ষের হৃৎপিণ্ড রয়েছে তার এই গ্রামেই। ডাক্তার যেমন রুগির চিকিৎসা শুরু করেন তার হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনে, তেমনই একশো কোটি মানুষের এই রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগ করতে হবে দেশের ৬০০,০০০ গ্রামের কথা শুনে।