বিষয়টি নিয়ে সচেতনতার প্রচার চালানো এবং এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার সম্ভাব্য কর্মসূচির মধ্যেই রয়েছে এর সমাধান। এই কাজ আমাদের শুরু করতে হবে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আমাদের নিজেদের বাড়ি থেকে। আমাদের কর্তব্য ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্যকর টয়লেটের প্রয়োজনীয়তা, তা বাড়িতে হোক, সাধারণ মানুষের যাতায়াতের স্থান হোক বা পরিবহণ সংশ্লিষ্ট স্থানেই হোক, সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা। স্থানীয় নাগরিক গোষ্ঠী তৈরি করতে হবে যারা এই বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করবে এবং কাজটিকে পর্যবেক্ষণে রেখে যথাসাধ্য সাহায্য করবে।
এই প্রসঙ্গে, আমি অন্ধ্রপ্রদেশের পেড্ডাপুরমের [Peddapuram] এম আর রাজুর কাজটির উল্লেখ করি। তিনি তাঁর গ্রামের নার্সারি ক্লাসের তিন বছরের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের এই ধরনের শিক্ষা দিচ্ছেন। তাঁর শিক্ষার মধ্যে দিয়ে তিনি তাদের ভাল খাদ্যস্বভাব ও শৌচস্বভাবের অভ্যাস করাচ্ছেন। এমন শিক্ষা আমাদের প্রতিটি স্কুলে প্রয়োজন।
স্যানিটেশন ও পানীয় জলের এক সংহত মিশন
ভারতের নগর, শহর ও মেট্রো শহরগুলির সমস্যা হল শৌচকর্মের সুযোগ সুবিধার অভাব। গ্রামাঞ্চলে এই সুযোগ সুবিধার অভাবের সঙ্গে আছে শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের অভাব। বাস্তবিকই এ এক জাতীয় সমস্যা। কেউ যদি প্রকল্পগুলি এবং তাদের বরাদ্দের পরিমাণ দেখেন, কোনও সময়েই তা নিমিত্ত মনে হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন তা হলে তুলনামূলকভাবে কোনও উন্নতির চিহ্ন দেখা যায় না, যখন অর্থ এবং অন্যান্য সম্পদাদি এতটা করেই ঢালা হচ্ছে প্রকল্পগুলিতে।
উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় যে, ভারতের প্রতি জনের জন্য প্রতি বছর ৩৫০ টাকা বিনিয়োগ করা হয় জল সরবরাহের ক্ষেত্রে। এই পরিমাণ যদিও আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় কম, কিন্তু তা একবিংশ শতকের প্রথম দশকের তুলনায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই সরবরাহ উপলব্ধও হচ্ছে অনেক বেশি মানুষের কাছে। গ্রামীণ স্যানিটেশন ব্যবস্থা যেখানে ১৯৮০ সালে ছিল প্রতি একশো জনে ১, সেখানে ২০০৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রতি শতকে ২১। উন্নত জল সরবরাহ ব্যবস্থা যেখানে ১৯৯০ সালে উপলব্ধ ছিল ৭২ প্রতি শতকে, তা ২০০৮-এ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৮৮ প্রতি শতক। আবার সঙ্গে সঙ্গে এও দেখা যায় যে, ভারতের মাত্র দু’টি শহরে আছে নিরবচ্ছিন্ন জল সরবরাহ ব্যবস্থা। আবার প্রতি একশো জন ভারতীয়র ভিতর প্রায় ৬৯ জনের কাছে এখনও উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা পৌঁছতে পারেনি।
সমস্যাটা হল কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে জল সরবরাহ আর স্যানিটেশনের দায়িত্ব ভাগ করে নেয় বিভিন্ন মন্ত্রক। কেন্দ্রীয় স্তরে আছে তিনটি মন্ত্রক: পানীয় জল ও স্যানিটেশন মন্ত্রক (গ্রামাঞ্চলের দায়িত্বে), বাসস্থান ও নগর দারিদ্র্য দূরীকরণ মন্ত্রক, এবং নগর উন্নয়ন মন্ত্রক (নগরাঞ্চলের দায়িত্বে)। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী জল সরবরাহ ও স্যানিটেশন রাজ্যের আওতায় পড়ে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রকগুলির শুধু পরামর্শ এবং সামান্য কিছু অর্থ বরাদ্দর ক্ষমতা আছে। ক্ষেত্রীয় যোজনা রাজ্যের অগ্রাধিকারে আসে। মূল বিষয়টি হল, বিভিন্ন সংস্থাগুলির মধ্যে একটি সুসংহত সহযোগ প্রয়োজন যাতে প্রকল্পগুলি যাদের উদ্দেশে রচিত তারা যেন তার পূর্ণ সুবিধা লাভ করতে পারে।
চলতি যে ব্যবস্থা রয়েছে, তার গুণাগুণ বিচারে একটি কার্যকরী মাপযন্ত্রের প্রয়োজন। ধরা যেতে পারে যে, যখন স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি হয়, তখন জনসাধারণের স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমার মতে, আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থার উপলব্ধতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকবে তীব্র ডায়ারিয়ার কেসগুলির হ্রাস পাওয়া।
সামাজিক অংশগ্রহণ
সেই সঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করা উচিত যে, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা এবং তাকে সার্বিকভাবে কার্যকরী করার দায়িত্ব শুধুমাত্র সরকারের উপর পড়ে না। পঞ্চায়েতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, এনজিও-গুলির এবং নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে এ ব্যাপারে। আমাদের সকলের উচিত এই বিষয়টিতে নজর দেওয়া, কারণ তবেই সকলের জন্য স্যানিটেশনের সুব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।
বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে মহাত্মা গাঁধী স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের উপর জোর দিতেন। স্যানিটেশন ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ছিল তাঁর অতি প্রিয় দু’টি বিষয়। পঞ্চায়েতের বিভিন্ন বিভাগের অংশগ্রহণ ছাড়া সার্বিক স্যানিটেশনের লক্ষ্যে পৌঁছনো অসম্ভব। যেহেতু তৃণমূল স্তরের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, তাই স্যানিটেশনের প্রচারে তারাই মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করবে।
মহিলাদের অংশগ্রহণও সমানভাবে অত্যন্ত জরুরি। স্বনির্ভর গোষ্ঠী, মহিলা সমক্ষ (মহিলাদের সম-অধিকারে শিক্ষা দান) এবং মহিলাদের গোষ্ঠীগুলিকে স্যানিটেশনের বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। দিতে হবে কিছু পারিতোষিক। আমি কীরাপালায়াম গ্রামে এ কাজ স্বচক্ষে দেখে এসেছি।
রেলের টয়লেট
আমাদের ট্রেনের টয়লেটগুলির যা দশা, তাদের বিষয়ে সত্বর দৃষ্টি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন। প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত যাতে মলমূত্র রেল লাইনে না পড়ে। যেহেতু আমাদের ট্রেনগুলির জন্য লক্ষ লক্ষ টয়লেটের প্রয়োজন, তাই টয়লেটগুলি যাতে সাশ্রয়ী হয় তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। রেল দপ্তর এমন কামরা চালু করতে পারে বা চলতি কামরাগুলিকে পরিবর্তন করে নিতে পারে, যেখানে আধুনিক ইউরিনাল, টয়লেট, বেসিন এবং আবর্জনা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা থাকবে যাতে রেললাইন পরিচ্ছন্ন থাকে আর যাত্রীদের ট্রেন যাত্রা হয় আরামদায়ক ও সুখকর।