বহুভাবেই ভারত আজ এক মহান রাষ্ট্র। যেসব রাষ্ট্রর কথা উল্লিখিত হল তাদের সঙ্গে সমপর্যায়ে উচ্চারিত হতে পারে তার নাম। সারা বিশ্ব তার প্রগাঢ় সমৃদ্ধশালী সভ্যতাকে শ্রদ্ধা করে। অনুপ্রাণিত করবার মতো বহু নেতা আজ বর্তমান। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন ও শিল্পে বহু মহান মানুষের জন্ম হয়েছে এই দেশে। কিন্তু একবিংশ শতকে ভারতকে সার্বিকভাবে এক মহান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এখনও কিছু পথ চলার বাকি আছে।
সেই শ্রেষ্ঠত্বের পথটি কিছু মৌলিকতার সাহায্যে শুরু হয়।
.
দুই : মূলের দিকে ফেরা
ভারতের বহু গ্রাম, নগর ও শহরের রাস্তায় আমি হেঁটে ঘুরেছি। প্রায় কুড়িটির মতো যে-সব দেশে আমি ভ্রমণ করেছি, সেখানেও আমি হেঁটেছি বেশ কিছু পথ। অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের একটি পার্থক্য হল, অন্য দেশের চাইতে আমাদের দেশের মানুষ অনেক বেশি পদসঞ্চারণ করেন। আর একটি পার্থক্য হল, অন্য দেশের নাগরিক তাঁদের রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নিজেরাই নেন। সেখানকার পুরদপ্তর অবশ্য নজর রাখেন যাতে আবর্জনা ফেলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে, এবং যাতে সেগুলি নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করা হয়। ঘন বসতিপূর্ণ টোকিও বা হংকং-এর মতো শহরগুলিও পরিচ্ছন্নতায় অনেক এগিয়ে। কারণ, সেখানে আছে কঠোর আইন এবং আছে সকল বয়সের নাগরিকদের জন্য রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। কিন্তু ভারতে সে ব্যবস্থা নেই।
যেখানে পরিচ্ছন্নতা ও হাইজিন, টয়লেট ও স্যানিটেশন বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ, সেখানে আমরা কী করে আশা করতে পারি আমাদের দেশ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশগুলির অন্যতম হবে? এ এক বিরাটাকার সমস্যা। গ্রাম-গঞ্জে, নগরে এমনকি বড় বড় শহরগুলিতেও আমরা দেখি শৌচালয়ের অপর্যাপ্ততা। যেখানে শৌচালয় আছে, সেখানে সেগুলি অপরিষ্কার এবং সেগুলির কোনও দেখভালও হয় না। পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা একেবারেই সঠিক না হওয়ায় আশপাশ হয়ে থাকে দুর্গন্ধময় এবং পোকা-মাকড়ের জন্মস্থান।
আমরা প্রত্যেকেই এই সমস্যার বিশালত্ব এবং সাধারণ জনসাধারণের উপর তার প্রভাব বিষয়ে ওয়াকিবহাল। স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি, নন-গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজ়েশন (এনজিও) এবং সাধারণ মানুষের সংযোগে এক উৎসর্গীকৃত কর্মোদ্যোগ গড়ে ওঠা। এর বিভিন্ন দিক আছে। যেমন, স্বাস্থ্য শিক্ষা, বিভিন্ন সংস্থাগুলির মধ্যে এক সংহত ক্রিয়াশীল সম্পর্ক স্থাপন যার ফলে গড়ে উঠবে সুযোগ সুবিধা, সাশ্রয়ী, এবং সর্বক্ষণের পর্যবেক্ষণ এবং উন্নতিসাধন।
কোনও রাষ্ট্রের উন্নতির মান বুঝতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হল সেখানকার স্যানিটারি ব্যবস্থা ও তার পরিকাঠামো। আমাদের পক্ষে কি সম্ভব শুধু এই বিষয়টির ভিত্তিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ হিসেবে ভারতকে তুলে ধরা? এই প্রশ্ন আমার মনে দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছে।
২০০৭ সালে আমার সুযোগ হয়েছিল ওয়ার্ল্ড টয়লেট সামিট-এ বক্তৃতা দেবার। এই শিখর সম্মেলন প্রতি বছর সংঘটিত হয় ওয়ার্ল্ড টয়লেট অর্গানাইজ়েশনের তরফে। সেই বছর তা নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় ও বিদেশি প্রতিনিধিরা সেখানে অংশগ্রহণ করেন। বিশ্বের একচল্লিশটি দেশ অংশ নেয় সেই সম্মেলনে। সেখানে উঠে আসে নানান চিন্তাভাবনা। স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতির বিষয়ে নানা কৌশলগত দিক নিয়ে আলোচনা হয়, যাতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই ব্যবস্থার সুস্থ প্রয়োগ করে উন্নতি করা যায়। সেইখানেই আমি দীর্ঘ সময় ধরে এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ পাই। এইখানে সেই চিন্তাভাবনাগুলি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
কীরাপালায়াম অভিজ্ঞতা
২০০৪ সালের অগাস্টে আমি তামিলনাডুর কুডালুর জেলার কীরাপালায়াম পঞ্চায়েত পরিদর্শনের জন্য যাই। সেই পঞ্চায়েতের আধিকারিকরা আমায় জানান যে, সেখানকার ১১২৫টি বাসগৃহের প্রতিটিতেই শৌচালয়ের ব্যবস্থা আছে। একটি বিষয় আমাকে আগ্রহান্বিত করল। গ্রামের মহিলারা নিজেরাই ইট-চুন-সুরকির কাজ শিখে নিজ নিজ বাসগৃহে শৌচালয় নির্মাণ করেছেন। শুধু নিজেদের পঞ্চায়েত অঞ্চলেই এই নির্মাণ কাজ তাঁরা করেননি, পার্শ্ববর্তী গ্রামেও তাঁদের এই নির্মাণ দক্ষতার পরিচয় রেখে এসেছেন। এর ফলে কর্মসংস্থানের একটা পথ যেমন উন্মুক্ত হল, তেমনই গ্রামগুলিতে দেখা গেল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রোগমুক্ত পরিবেশ।
ওই রাজ্যের রামানাথাপুরম জেলার থামারাইকুলম পঞ্চায়েতেও একই ফল পাওয়া গেল। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের বিভিন্ন গ্রামে, গঞ্জে, শহরে বিক্ষিপ্ত এমন কিছু উদাহরণ আমরা পাব। এমন একটি তথাকথিত ‘সরল’ সমাধান, যা সারা দেশেই প্রযোজ্য হতে পারে, তা কিন্তু আমাদের নজরের বাইরেই থেকে গিয়েছে এতকাল। ভারতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং ঘিঞ্জি বাসস্থানের কারণে আজ এই সমস্যা আকাশছোঁয়া চেহারা নিয়েছে। অতি দ্রুত আমাদের একটি সুসংহত ব্যবস্থার আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই সমস্যা মোকাবিলায়।
সমাধান
বাস্তবে কীরাপালায়াম আর থামারাইকুলম ভারতে সত্যই ব্যতিক্রমী উদাহরণ। সাধারণভাবে শৌচালয় আর স্যানিটেশনের ছবিটা আমাদের দেশে খুবই ভয়ানক। এবং তার জন্য অন্য কেউ না, আমরাই দায়ী। আমাদের আশপাশে তাকালে স্কুল, কলেজ, রেলস্টেশন এবং সাধারণ মানুষের যাতায়াতের স্থানগুলির টয়লেটের প্রাচীন চেহারা দেখে আমরা মনে করি, এর পরিবর্তন অসম্ভব। এই নিয়েই আমাদের থাকতে হবে হয়তো। এমনই বদ্ধ চিন্তাধারা আমাদের। কিন্তু, না, এমন ভাবে চলতে পারে না।