এর অর্থ, যারা তোমার সঙ্গে অসদাচরণ করবে, তাদের সঙ্গে তুমি সু-আচরণ করো। রাজনৈতিক দুই নেতা, মহাত্মা গাঁধী এবং ড. নেলসন ম্যান্ডেলা, পৃথিবীর এক ষষ্ঠাংশ জনসংখ্যার যথাক্রমে, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁদের দেখানো পথে অন্য বহু রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে শামিল হয়েছে।
ইউরোপ
এবার আমরা ইউরোপের দিকে তাকাই এবং খুঁজে নিই শ্রেষ্ঠত্বের কোন পাঠ আমরা তাদের কাছ থেকে পেতে পারি।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে ইউরোপীয় সভ্যতার একটি অনন্য স্থান আছে। সেখানকার মানুষেরাই এই গ্রহকে প্রথম অন্বেষণ করে বেড়িয়েছে। তারাই শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী চিন্তাভাবনার জন্ম দিয়ে তাদের উন্নতিসাধন করেছে। কিন্তু অন্যদিকে এই ভূখণ্ডেই সেখানকার বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত হয়েছে শয়ে শয়ে বছর ধরে, যার মধ্যে আছে গত শতকের দু’টি বিশ্বযুদ্ধ।
এতত্সত্ত্বেও, তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) প্রতিষ্ঠা করল। লক্ষ্য, সমগ্র অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট সব রাষ্ট্রের মধ্যে সংযোগের উদাহরণ হয়ে আছে। তেমনই সম্ভবত, রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা নিষ্ক্রান্ত করেছে এবং ওই অঞ্চলে এক চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের নিদর্শন হয়ে আছে, এই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। পরস্পরের একান্ত নিজস্ব দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে একটি স্থিতিশীল শান্তির পরিবেশ রচনার এই ধরনের আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ইইউ যেন এক পথপ্রদর্শক। বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির উচিত ইইউ-র মতো আঞ্চলিক সহযোগিতাকে বৃদ্ধি করে এক উন্নততর স্থায়ী বিশ্বশান্তির পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা।
সিঙ্গাপুর
আবার অন্যদিকে আছে একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর। এটি এমন একটি দেশ যার নিজস্ব কোনও প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, তার জনসাধারণ ছাড়া। এই জনসাধারণই তাঁদের জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে দেশটিকে করে তুলেছেন অর্থনৈতিকভাবে এক উন্নত রাষ্ট্র। দেশের নেতৃবৃন্দের ভিতরেও জনগণের এই গুণগুলি বর্তমান। তাঁরা সততা ও আত্মনিয়োগের প্রতিমূর্তি। লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, ১৯৫৯ থেকে ১৯৯০। তাঁর মননশীল নেতৃত্বে সিঙ্গাপুরকে তিনি করে তুলেছেন এক মহান বহুসংস্কৃতির সংহত রাষ্ট্র, যার লক্ষ্য ছিল একটিই— সিঙ্গাপুরই। তাঁর নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর হয়ে উঠল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এক রাষ্ট্র, যার সংস্কৃতি তার নাগরিকদের করে তুলল তাঁদের দেশ সম্পর্কে গর্বিত এবং দেশের আইনকে মান্যতা দিয়ে তাঁরা নিজেদের যাপনকে করে তুললেন সুস্থির।
ইউনাইটেড স্টেটস অফ অ্যামেরিকা
জ্ঞানত মাত্র ২৫০ বছরের দেশ এই ইউনাইটেড স্টেটস অফ অ্যামেরিকা (ইউএস)। কিন্তু এদের থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। ধরা যাক, তাদের গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা অথবা প্রাকৃতিক বা অর্থনৈতিক বা অন্যান্য প্রতিকূলতাকে যুঝে তাদের সমাধান করার ক্ষমতা। মার্কিন দৃষ্টিকোণ ও স্বপ্ন আজ তার দেশের জনগণের জন্যই বিশ্বময় একটি বহুল প্রচারিত ও আলোচিত ধারণা। সেখানে প্রত্যেক দেশবাসী চান অ্যামেরিকা বিশ্বে একনম্বর রাষ্ট্র হবে। এই ভাবধারাই ইউএস-কে প্রতিনিয়ত করে তুলছে উন্নত। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, শিল্প— সকল ক্ষেত্রেই তারা নেতৃত্ব প্রদানে এগিয়ে।
মহান নেতারা কীভাবে একটি মহান রাষ্ট্রের জন্ম দেন, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই ইউএস। স্বপ্নদর্শী কিছু পুরুষ ও মহিলা একটি রাষ্ট্রকে দিয়েছেন তার দিশা এবং জুগিয়েছেন তার স্থায়িত্ব। থমাস জেফারসন এবং জর্জ ওয়াশিংটন ইউএস-কে দিয়েছিলেন তার শক্তপোক্ত গণতান্ত্রিক বুনিয়াদ। আব্রাহাম লিঙ্কন তাঁর জীবনকে বাজি রেখে উচ্ছেদ করলেন দাসপ্রথা। ড. ম্যান্ডেলা যদি মহাত্মা গাঁধীর পথ অনুসরণ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় জাতি-বর্ণ-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করে থাকেন, তো ইউএস-এ গাঁধীজির অনুপ্রেরণায়ই ওই একই পথে হেঁটেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ারের মতো নেতৃবৃন্দ। এমনই সব মহান নেতারা তাঁদের কাজের মাধ্যমে তাঁদের দেশকে করে তুলেছিলেন মহিমান্বিত। তাঁদের হত্যাকাণ্ডর ঘটনাগুলি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্বাধীনতা ও ন্যায়ের সংগ্রামকে দৃঢ়তর করেছে।
ভারত
পরিশেষে আসা যাক ভারতের কথায়। ভারত ও ইউএস-এর মধ্যে কিছু মিল পাওয়া যায়, বহু পার্থক্য সত্ত্বেও। আবার অন্যদিকে, ভারতীয় সভ্যতা কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন। তেমনই, ভারতে বিভিন্ন ভিনদেশের আগ্রাসন হয়েছে, তার আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য। ইউএস-এর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। কিন্তু, দুই রাষ্ট্রই আজ আধুনিক, বহুসংস্কৃতির, বহুধর্মের, বহুভাষার দুই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী পৃথিবীর বিভিন্ন রাজবংশ ভারতে তাদের শাসন কায়েম করে গিয়েছে । কিন্তু এই বিদেশি আক্রমণকারীরা ভারতবর্ষের ইথস বা যাকে বলা যায় মূল ধারণাকে তাদের মধ্যে আহরণ করে নিয়েছে। আর ভারত ভিন্ন সভ্যতার গুণগুলিকে নিজের মধ্যে আত্মীকরণ করে নিয়েছে। সে বহু হিংস্রতা প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু আজ সে অহিংসার পুণ্যভূমি। একটি মানুষ তা তিনি সম্রাট অশোকই হোন বা মহাত্মা গাঁধীই হোন, তাঁদের মননশীল নেতৃত্ব আমাদের জাতীয় চরিত্রের উপর প্রভাব ফেলে।