সমাজ ভিত্তিক উন্নতির রাডার
উন্নতির রাডার প্রস্তুত করার কারণ, ইউসিপি কেমনভাবে ইউজ়ারদের লাভবান করেছে, তা পর্যালোচনা ও নজরে রাখা। ন’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এইটি করতে হবে। সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে এই বিষয়গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়গুলি হল:
১। খাদ্য ও পুষ্টি
২। পানীয় ও কৃষিতে ব্যবহারযোগ্য জল অধিগত করার সুযোগ
৩। স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার সুযোগ
৪। রোজগার করার ক্ষমতা পাওয়া
৫। শিক্ষা ও দক্ষতা নির্মাণের সুযোগ পাওয়া
৬। উত্তম শক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পাওয়া
৭। সমাজ ভিত্তিক সংঘর্ষের অবস্থান
৮। অর্থনৈতিক সাহায্য প্রাপ্তি
৯। পরিচ্ছন্ন ও সবুজ পরিবেশ প্রাপ্তি
সমাজ ভিত্তিক উন্নতির রাডারের তিনটি লক্ষ্য থাকবে। প্রথমটি হল ওই ন’টি বিষয়ের বর্তমান অবস্থা নিরীক্ষণ করা। দ্বিতীয় লক্ষ্যটি হল মাঝামাঝি সময়ের টারগেট রেখে তৃতীয় একটি দীর্ঘ সময়ের লক্ষ্য স্থির করা। তবে তা একটি নির্দিষ্ট সময়সীমায় বাঁধা রাখতে হবে।
‘পুরা’ ভাবনাটি যখন এইভাবে প্রয়োগ করা হবে, তখন বিশ্বব্যাপী ৩ বিলিয়ন গ্রামীণ জনসাধারণের জীবনের মান উন্নত হবে স্থায়ী উন্নয়নের প্রক্রিয়ায়। সব দিক থেকে উত্তম একটি সাম্যের সুন্দর পৃথিবী তৈরি হবে।
.
ষোলো : উপসংহার
এই বইয়ের ভূমিকায় ভুবনেশ্বর থেকে দিল্লির প্লেনে এক বিদেশি যাত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে আমি আমাদের জাতীয় চরিত্রের বিষয়ে সেই ঘটনাটি কী নির্দেশ করে, তা বলেছিলাম। তেমনই একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে আমি বইটি শেষ করি।
এমিনেন্ট পারসনস গ্রুপের একটি মিটিং সেরে আমি সিওল থেকে ২৯ নভেম্বর ২০১১-র রাত্রে একটি ননস্টপ উড়ানে দিল্লি ফিরছিলাম। পরের বছর সিওল নিউক্লিয়ার সিকিউরিটি সামিট সম্মেলনের আগে এই মিটিংটি আয়োজন করেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি। এই মিটিং-এ এসেছিলেন বিভিন্ন দেশের আণবিক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা। এমিনেন্ট পারসনস গ্রুপের লক্ষ্য ছিল সারা বিশ্বে যে ৫৩৯টি আণবিক শক্তি প্লান্টগুলি রয়েছে তাদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি নির্দেশাবলি প্রস্তুত করা। সেই সম্মেলনের বিষয়ে বিস্তারিত এখানে বলছি না, তবে এক জাপানি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ এবং প্রাক্তন কূটনীতিক শিনিচি কিতাওকা আমাকে এবং এমিনেন্ট পারসনস গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের যে ঘটনার কথা বলেছিলেন, সেইটি বলব।
অধ্যাপকটি বলছিলেন, তাঁর দেশে সেই বছর মার্চ মাসে ফুকুশিমা দাইচির যে আণবিক বিপর্যয়টি ঘটেছিল, তার কথা। ১১ মার্চ ২০১১ সালে তোহোকুতে ভূমিকম্পর জেরে যে সুনামিটি হয়, সেইটি ফুকুশিমা-১ আণবিক শক্তি কেন্দ্রের দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়। ভূমিকম্পর ঠিক পরেই চালু থাকা রিঅ্যাকটরগুলি আপনাআপনি তাদের নিরন্তরভাবে চলতে থাকা ফিশন বিক্রিয়াগুলি বন্ধ করে দেয়। রিঅ্যাকটরগুলিকে যে আপতকালীন জেনারেটরগুলি ঠান্ডা রাখে সেগুলিকে সুনামি ধ্বংস করে দেয়। ফলে, তিনটি নিউক্লিয়ার মেল্টডাউন ঘটে এবং রেডিওঅ্যাকটিভ বস্তু ছড়িয়ে পড়ে। এরপরের কয়েকদিন হাইড্রোজেন-বায়ুর রাসায়নিক বিক্রিয়াজনিত বেশ কিছু বিস্ফোরণ হয়।
তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের চের্নোবিলে ১৯৮৬ সালে ঘটে যাওয়া আণবিক বিপর্যয়ের পর ফুকুশিমা দুর্ঘটনাটির মতো এমন বিপর্যয় পৃথিবী আর দেখেনি। কিন্তু চের্নোবিলে যা ঘটেছিল তা ফুকুশিমাতে দেখা গেল না। একটিও রেডিয়েশন জনিত মৃত্যু ঘটেনি এখানে।
‘দু’টি জাপানি শহর ১৯৪৫ সালে আণবিক অস্ত্রের আক্রমণের শিকার হয়েছিল।’ বললেন অধ্যাপক কিতাওকা। ‘সেটি ছিল অত্যন্ত দুঃসহ এক ট্র্যাজেডি, কিন্তু জাপানি নাগরিকরা তা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করে, মাত্র তিন দশকের মধ্যে জাপানকে বিশ্বের সব থেকে অগ্রণী শিল্পসমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। এখন, ফুকুশিমা শক্তি কেন্দ্রটির সমস্যা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা, জাপানিরা, কখনওই এই সমস্যাকে আমাদের কর্তা হতে দেব না। আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় আমরা, জাপানিরা, নিজেরাই সমস্যাটির কর্তা হয়ে তাকে পরাস্ত করে সফল হব। এবং বিশ্ব দেখবে এক পরিচ্ছন্ন ও সবুজ আণবিক শক্তি চতুর্দিকে উদ্বোধিত হচ্ছে।’
একটি রাষ্ট্র তখনই শ্রেষ্ঠ হয় যখন সে কোনও গভীর চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে সেই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝে, নিজের ভিতরের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রকাশ করে এবং রাষ্ট্রের মানুষ এক হয়ে সমস্যাকে পরাস্ত করে তার উপর কর্তৃত্ব করে। জাপানের মতো এক মহান দেশের এইটিই জাতীয় চরিত্র।
ভারতকে এমন মহান দেশগুলির উদাহরণ থেকে অনেক কিছু শিখতে হবে। আমি যখন ভারতের কোনও পঞ্চায়েতে, গ্রামে বা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনে যাই, এক থেকে দু’ঘণ্টার ভিতরেই আমি বুঝে যাই সেই জায়গা ভাল নেতাদ্বারা ঠিকঠাক প্রশাসিত হচ্ছে কিনা। আমি এও বুঝতে পারি যে সেই জায়গার নাগরিকরা সমবেতভাবে তাদের নিজেদের বাড়ি, আশপাশ, গ্রাম বা শহরের দায়িত্ব নিচ্ছেন কিনা। দুর্ভাগ্যবশত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ নাগরিকদের ভিতর বা তাঁদের নির্বাচিত সরকারের সকল স্তরের প্রতিনিধিদের ভিতর এই স্পিরিটটা দেখতে পাওয়া যায় না।